এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৮ জন নিহত, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২২৯ জনের

দেশের সড়কে মৃত্যু থামছে না। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসেও ভয়াবহ রূপে দেখা দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে, শুধু এপ্রিল মাসেই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮৮ জন। আহত হয়েছেন আরও ১১২৪ জন।
এই বিপুল প্রাণহানির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। ২১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২২৯ জনের। একদিকে বেড়ে চলেছে যানবাহনের সংখ্যা, অন্যদিকে নিরাপত্তার অভাব ও ট্রাফিক শৃঙ্খলার ঘাটতি সড়ক দুর্ঘটনাকে করে তুলেছে নিত্যদিনের দুর্যোগে।
প্রতিবেদন প্রস্তুত: ৯টি জাতীয় পত্রিকা ও ৭টি অনলাইন পোর্টালের ভিত্তিতে
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, এই মাসিক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে দেশের ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে। মোট ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এপ্রিলের দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের বিবরণ
- মোট সড়ক দুর্ঘটনা: ৫৯৩টি
- মোট নিহত: ৫৮৮ জন
- মোট আহত: ১১২৪ জন
- নারী নিহত: ৮৬ জন
- শিশু নিহত: ৭৮ জন
এর বাইরে সড়ক ছাড়া ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত ৮ জন, আহত ৪ জন এবং রেলপথে ২২টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ জন, আহত ৬ জন।
বিভাগভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
রিপোর্টে দেশের ৮টি প্রশাসনিক বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। নিচে বিভাগভিত্তিক চিত্র তুলে ধরা হলো:
বিভাগ | দুর্ঘটনা | নিহত |
---|---|---|
ঢাকা | ১৭৩ | ১৫৪ |
চট্টগ্রাম | ৩৫ | ৪৬ |
রংপুর | ৩১ | ৩২ |
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ | সম্মিলিত তথ্য প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ হয়নি | |
ঢাকা মহানগরী | ৩৪ | ১৯ (আহত ২৭) |
নীলফামারী | দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি হয়নি |
ঢাকা বিভাগেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, যা জাতীয় চিত্রে ট্র্যাজেডির মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে নীলফামারীতে দুর্ঘটনা ঘটলেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি, যা একটি আশাব্যঞ্জক দিক।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সবচেয়ে প্রাণঘাতী
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ভয়াবহতা। শুধু এপ্রিল মাসেই ২১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের অনেকে ছিলেন কিশোর ও তরুণ। গত কয়েক বছরে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার হু হু করে বাড়লেও চালকদের প্রশিক্ষণ, হেলমেট ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইনের মান্যতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকটি প্রধান কারণ, যা সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী:
- ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন
- বেপরোয়া গতি
- চালকদের অদক্ষতা
- মহাসড়কে স্বল্পগতির যান চলাচল
- ট্রাফিক আইন অমান্য করে রাস্তা পার হওয়া
- ফুটপাত ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে অনীহা
এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে ভবিষ্যতে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আগের মাসের তুলনায় কমলেও রয়ে গেছে উদ্বেগ
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে সড়কে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬১২ জন, যা এপ্রিল মাসের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই, কারণ প্রতি মাসেই গড়ে ৫০০-৬০০ জনের প্রাণহানি ঘটছে দেশের সড়কে, যা একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বিশেষজ্ঞ মতামত: ‘আইন বাস্তবায়নই মূল চাবিকাঠি’
ট্রাফিক বিশ্লেষক ও সড়ক নিরাপত্তা গবেষকরা মনে করছেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে শুধু জনসচেতনতা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, চালকদের লাইসেন্সিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং যানবাহনের নিরাপত্তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল মতিন খান বলেন,
“প্রতিদিন যেখানে গড়ে ২০ জন মানুষ সড়কে প্রাণ হারায়, সেখানে এটি আর স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। এটা একটি জাতীয় সংকট। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণ—সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।”
একটি নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশায় বাংলাদেশ
এপ্রিল মাসের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—সড়কে মৃত্যু এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিদিনের অসাবধানতা, অব্যবস্থাপনা ও আইনের শিথিল প্রয়োগ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর আরও কার্যকর পদক্ষেপ, ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করাই হতে পারে এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।