মিয়ানমারে আবারও কম্পন, প্রতিবেশী দেশ আতঙ্কে

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ মিয়ানমার আবারও কেঁপে উঠেছে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্পে। দেশটির মেইকটিলা শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রোববার সকালে এই ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৯। ভূমিকম্পটি সানাইং ফল্ট লাইনের কারণে সংঘটিত হয়েছে বলে জানা গেছে, যা গত ২৮ মার্চেও একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্ম দিয়েছিল। তখন বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা এবং আবাসিক ভবন ধসে পড়েছিল।
মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় বড় ভূমিকম্প
গত ২৮ মার্চের ভয়াবহ ভূমিকম্পের রেশ কাটতে না কাটতেই ফের কম্পন অনুভূত হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের ভূমিকম্পটি সকাল ৯টা ২৪ মিনিটে অনুভূত হয়, এবং এটি ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তি হয়। এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাণহানি বা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি, তবে বিস্তারিত তথ্যের জন্য উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়েছেন।
ভূমিকম্পের ভৌগোলিক বিবরণ
থাইল্যান্ডের খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী—
- মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (USGS) অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের মেইকটিলা শহরের উত্তর-পূর্বে।
- এটি থাইল্যান্ডের উত্তর মায়ে হং সন প্রদেশের মুয়াং জেলা থেকে ২৭১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
- ভূমিকম্পটি সানাইং ফল্ট লাইনের সক্রিয়তার কারণে হয়েছে।
এই একই ফল্ট লাইন পূর্বে ২০১৬, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৫ সালের মার্চ মাসেও ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছিল। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বিপজ্জনক ভূকম্পন এলাকা।
প্রতিবেশী দেশগুলোতেও কম্পন অনুভূত
এই ভূমিকম্প শুধু মিয়ানমারেই নয়, পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কিছু অঞ্চলেও অনুভূত হয়েছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই, চিয়াং রাই এবং মায়ে হং সন প্রদেশের বাসিন্দারা এর কম্পন বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছেন।
চিয়াং মাইয়ের মুয়াং জেলার তাম্বন সুথেপের এক বাসিন্দা জানান:
“আমি সপ্তম তলার অ্যাপার্টমেন্টে ছিলাম। হঠাৎ করেই বিছানার নিচে কেঁপে উঠল এবং পাখার মতো জিনিস নড়তে লাগল, যদিও সেটি বন্ধ ছিল।”
চিয়াং রাইয়ের এক ছাত্রাবাসের বাসিন্দাও বলেন:
“ঘুম থেকে জোরে উঠলাম। বিছানাটা কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল কিছু একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটছে।”
মালয়েশিয়ার প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী কম্পন
মালয়েশিয়ার আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকেও ভূমিকম্পটির কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের মতে, এটি ছিল মাঝারি ধরনের একটি ভূমিকম্প। তবে এই ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ পর, সকাল ৯টা ৪২ মিনিটে, মায়ে হং সন প্রদেশের পাই জেলার তাম্বন মায়ে না তোং এলাকায় আরও একটি ছোট আকারের ১.৮ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়।
যদিও এই পরবর্তী কম্পনটি মূল ভূমিকম্পের আফটারশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তবে ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, এর ভিত্তিতে আরও বড় আফটারশকের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনার ঝুঁকি
মিয়ানমারের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বহু প্রাচীন বৌদ্ধ প্যাগোডা ও মঠ রয়েছে। বিশেষ করে বাগান (Bagan) অঞ্চলে হাজার বছরের পুরনো শত শত প্যাগোডা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
গত ২৮ মার্চের ভূমিকম্পে একাধিক প্যাগোডা আংশিক বা সম্পূর্ণ ধসে পড়ে। এবারের ভূমিকম্পেও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত এখনও জানা না গেলেও স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে জরুরি পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে।
প্রশাসনের সতর্কতা ও প্রস্তুতি
মিয়ানমারের আবহাওয়া ও ভূতাত্ত্বিক বিভাগ সাধারণ নাগরিকদের ভূমিকম্প পরবর্তী নিরাপদ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। জরুরি পরিস্থিতির জন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
তবে ভূমিকম্প মোকাবিলায় মিয়ানমারের সক্ষমতা সীমিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকেও সহযোগিতা চাওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কেন এই অঞ্চলে ভূমিকম্প বারবার?
সানাইং ফল্ট লাইন হচ্ছে একটি সক্রিয় ভূ-প্রকৃতি, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এটি দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত— ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট ও ইয়াংটসে প্লেট।
এই প্লেটগুলোর ক্রমাগত সঞ্চরণ এবং সংঘর্ষের ফলেই এই এলাকায় ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। ভূতাত্ত্বিকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
কী করতে হবে ভূমিকম্পের সময়?
সাধারণ মানুষের সচেতনতার জন্য বিশেষজ্ঞরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন—
- ভূমিকম্প শুরু হলে তৎক্ষণাৎ টেবিল বা শক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
- খোলা জায়গায় চলে যাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।
- লিফট ব্যবহার করা যাবে না, বরং সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে।
- মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক ও প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রস্তুত রাখা জরুরি।
ভূমিকম্পের সঙ্গে বসবাস, কিন্তু সচেতনভাবে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভূমিকম্পপ্রবণ একটি অঞ্চল, এ কথা আমরা বারবার শুনি। তবে সচেতনতা, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এবং তথ্যভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া এই দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। মিয়ানমারের এবারের ভূমিকম্প আবারও স্মরণ করিয়ে দিল— প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো না গেলেও এর ক্ষতি কমানো সম্ভব প্রস্তুতির মাধ্যমে।