বিশ্ব

ফিলিস্তিনি শিশুদের গণহত্যা ও নীরব বিশ্ব বিবেক

গাজায় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ প্রাণ হারাচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একজন শিশু নিহত হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১৭ হাজার ৪০০ শিশু। ভয়াবহ এই পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে—অসংখ্য পরিবার হারিয়েছে পুরো প্রজন্ম।

এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যখন কিছু মানবাধিকার সংগঠন, স্বতন্ত্র সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করছেন, তখন বিশ্ব নেতারা যেন ‘ইচ্ছাঘুমে’ আচ্ছন্ন। তারা যেন দেখেও দেখছে না, শুনেও শুনছে না।

গণহত্যার বাস্তব চিত্র

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা ও পুনর্বাসন সংস্থা (UNRWA) জানিয়েছে, গাজায় গত দেড় বছরে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন শিশু নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল গাজায় একতরফা সামরিক অভিযান শুরু করে, যার জবাবে হামাস প্রতিরোধ শুরু করে। তবে ইসরায়েলের পাল্টা হামলা ক্রমেই এক ধরনের সংগঠিত গণহত্যার রূপ নেয়।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, কেবল মার্চ ২০২৫-এই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে ৩০০ জনের বেশি শিশু। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে আরও শত শত শিশু। বহু শিশুর লাশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি, কারণ ইসরায়েলি বাহিনী টার্গেট করছে রেসকিউ টিম, এম্বুলেন্স ও হাসপাতালকেও।

হিন্দ রজব থেকে মুহাম্মদ আল-দুররা—এক ইতিহাস রক্তাক্ত শিশুর

২০০০ সালে বিশ্ব দেখেছিল ১২ বছর বয়সী মুহাম্মদ আল-দুররার নিষ্পাপ মৃত্যু। তার বাবার কোলে আশ্রয় নেওয়ার পরেও ইসরায়েলি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তার শরীর। সেই স্মৃতি এখনো মুছে যায়নি বিশ্ববাসীর মন থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে নিহত হয় পাঁচ বছর বয়সী হিন্দ রজব। সহায়তার আকুতি জানিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিল একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়িতে, যেখানে তার পরিবার আগেই প্রাণ হারিয়েছিল।

এই ঘটনাগুলো শুধু দু’একটি ব্যতিক্রম নয়, বরং একটি ধারাবাহিক এবং পূর্বপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের স্পষ্ট উদাহরণ।

শিশুদের হত্যা: একটি ‘রাষ্ট্রীয় নীতি’?

গাজার জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি শিশু। এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়েই যেন ইসরায়েল তাদের আগ্রাসন পরিচালনা করছে। লক্ষ্যস্থল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র, খেলার মাঠ, হাসপাতাল ও এমনকি শিশুরা যেখানে আশ্রয় নিচ্ছে সেসব ঘরবাড়ি। আন্তর্জাতিক আইনে এই ধরনের স্থাপনাগুলো রক্ষা করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু ইসরায়েল এসব আইন তোয়াক্কা করছে না বলেই বারবার অভিযোগ উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল এক দেশ বা অঞ্চলকে কাবু করতে নয়, বরং ভবিষ্যতের একটি প্রজন্মকে মুছে ফেলার সুপরিকল্পিত প্রয়াস।

বিশ্ব বিবেক কোথায়?

বিশ্বের বড় বড় নেতারা ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা অন্যান্য মানবিক সংকটে তৎপরভাবে প্রতিক্রিয়া জানালেও, গাজার শিশুদের ব্যাপারে তারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এই দ্বিমুখী নীতি নিয়েই ক্ষুব্ধ ইসরায়েলি মানবাধিকারকর্মী ইৎজাক ফ্রাঙ্কেনথাল। তাঁর মতে, ‘‘এটি বিকৃত ভণ্ডামি, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধে ঠেলে দেয়। আমরা সেনাবাহিনীর ‘নৈতিকতা’ নিয়ে গর্ব করি, অথচ সেই সেনাবাহিনীই শিশুদের হত্যা করে।’’

অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপ

ইসরায়েলের সাবেক পার্লামেন্ট স্পিকার আব্রাহাম বুর্গ ২০০৩ সালেই সতর্ক করেছিলেন—‘‘যদি ইসরায়েল ফিলিস্তিনি শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভাবে, তাহলে একদিন এই শিশুরাই ফিরে আসবে ঘৃণায় পরিপূর্ণ হয়ে।’’

এই কথাগুলো শুনেও শুনেননি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযুক্ত এবং নিজ দেশেও দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি।

গণহত্যা থামবেই—এটা সময়ের দাবি

ইতিহাস সাক্ষী, দখলদারত্ব কখনো চিরস্থায়ী হয়নি। প্রতিটি গণহত্যার বিচার এক সময় হয়েছে। রুয়ান্ডা, বসনিয়া কিংবা মায়ানমার—প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দোষীদের জবাবদিহি করতে হয়েছে। গাজা তার ব্যতিক্রম হবে না।

ইসরায়েলি নেতৃত্ব যদি মনে করে এই হত্যাযজ্ঞ চিরস্থায়ী নিরাপত্তা আনবে, তবে তারা বড় ভুল করছে। বরং, প্রতিটি শিশুর মৃত্যু আরও হাজারো প্রতিরোধ জন্ম দিচ্ছে।

এই মুহূর্তে বিশ্ব নেতাদের উচিত, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের মাধ্যমে শিশু হত্যার দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা। যুদ্ধ নয়, মানবতা হোক পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের উপহার।

এই পৃথিবী তখনই নিরাপদ হবে, যখন গাজার প্রতিটি শিশুর জীবন মূল্য পাবে। যখন একটি শিশুর মৃত্যু মানে হবে—একটি জাতির অপূরণীয় ক্ষতি, এবং একটি সভ্যতার ব্যর্থতা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button