আঞ্চলিক

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলেন জয়, আ.লীগের চূড়ান্ত ‘নৌকাডুবি’

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা ও টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে, ঠিক সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন দলের সম্ভাব্য উত্তরাধিকার সজীব ওয়াজেদ জয়। দীর্ঘদিন ধরে তাকে দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা থাকলেও তার এই সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ‘চূড়ান্ত নৌকাডুবি’ হয়েছে।

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। সেই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারাও কেউ কেউ ভারতে, কেউ ইউরোপে চলে গেছেন। অনেকে বর্তমানে কারাগারে। এসব ঘটনার জের ধরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পড়েন চরম দিগ্ভ্রান্তির মধ্যে।

এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল – কে হাল ধরবেন? দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ই দলীয় নেতৃত্বে আসুন। তার কথায়, সিদ্ধান্তে এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপে এ বার্তা স্পষ্ট ছিল। জয়কে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছিল, দেওয়া হয়েছিল দলের সদস্য পদ। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায়, বক্তৃতা ও সংবাদমাধ্যমে তার ‘অবদানের’ প্রচার চালানো হতো। মূলত এসবের মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল – শেখ হাসিনার পরে জয়ই হবেন নেতৃত্বের উত্তরাধিকার।

সজীব ওয়াজেদ জয় যদিও দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন না, তবে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অগাধ। ‘জয়ের কোটা’য় মন্ত্রী-এমপি নিয়োগের গুঞ্জন ছিল অনেক দিন ধরে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতসহ সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল জয় ও তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনেও ‘জয় অনুসারী’ একটি শক্তিশালী গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছিল, যারা ছিলেন প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে।

তবে সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ। গত শনিবার ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস সিটিজেনশিপ সেন্টারে আয়োজিত এক নাগরিকত্ব শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন জয়। সেদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ২২ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। বাংলাদেশ থেকে ছিলেন তিনজন, যাদের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে শপথ পাঠ করেন জয়। শপথ শেষে তাকে নাগরিকত্ব সনদপত্র দেওয়া হয় এবং পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে বিস্ময় ও হতাশার ছায়া। অনেকেই বলছেন, যখন দলের নেতৃত্বহীন অবস্থায় কর্মীরা মাঠে নিপীড়িত হচ্ছেন, মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন, তখন জয় তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে নিজেই আরেক দেশের নাগরিক হলেন। এর মানে, তিনি আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অংশ হতে চান না। ফলে তার ওপর ভর করে দল পুনর্গঠনের যেসব পরিকল্পনা ছিল, তা ভেস্তে গেছে।

দলের একাধিক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার পরে নেতৃত্বে কে আসবেন – তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুটি ধারা প্রচলিত ছিল। একটি হল শেখ হাসিনার ভাই শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক ববির পক্ষে, অন্যটি জয় ও তার বোন পুতুলের পক্ষে। শেখ হাসিনা সব সময় জয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জয় নিজেই নিজেকে আলাদা করে নেওয়ায় নেতৃত্বের শূন্যতা আরও প্রকট হলো।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ২০১৮ সালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জয় বলেছিলেন, তার কোনো বিদেশি পাসপোর্ট নেই এবং তিনি শুধু বাংলাদেশি সবুজ পাসপোর্টই ব্যবহার করেন। তিনি তখন লিখেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি থাকলেও বাংলাদেশি নাগরিকত্বই আমার পরিচয়।” সেই বক্তব্যের ছয় বছর পর এসে ভিন্ন পথে হাঁটার ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন – তাহলে ওই ঘোষণার সত্যতা কোথায়? নাকি তখন তিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বক্তব্য দিয়েছিলেন?

আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, “জয় নাগরিকত্ব নিয়েছেন – এটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু দল যখন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে, তখন এমন সিদ্ধান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। তিনি যদি সত্যিই দলের ভবিষ্যৎ নেতা হতে চাইতেন, তাহলে এখনই সামনে আসার কথা ছিল, পালিয়ে যাওয়ার নয়।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণের মাধ্যমে জয় মূলত বাংলাদেশের সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। এতে আওয়ামী লীগের জন্য নতুন নেতৃত্ব খোঁজার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও দলটি বর্তমানে নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে, তবু ভবিষ্যতে রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইলে নতুন মুখ খুঁজে বের করতেই হবে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে হতাশা গভীর। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম জয় হাল ধরবেন। কিন্তু তিনিও চলে যাওয়ায় আমাদের কোনো দিক নির্দেশনা নেই। দল হিসেবে আমাদের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে।

পরিস্থিতির এমন মোড় আওয়ামী লীগের জন্য শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও বড় ধাক্কা। দলের ভিতর থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার নতুন সম্ভাবনা না থাকলে, দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে একেবারেই মুছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button