রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি মানবিক সমস্যা নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশ শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান জানালেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারসহ সকল পক্ষের সঙ্গে কাজ করে চলেছে এবং এ ব্যাপারে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) কক্সবাজার শহরের রাখাইন পল্লীতে জলকেলি উৎসব উপলক্ষে ‘শুভ রাখাইন সাংগ্রেং ১৩৮৭’ শীর্ষক এক আলোচনাসভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. খলিলুর রহমান এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, “আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি, যাতে আরাকানে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এর মাধ্যমেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হবে। আমাদের বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা সফল হবে।”
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার এমন বক্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, এই মুহূর্তে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের মতো পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। তবে বাংলাদেশ আশাবাদী, কূটনৈতিক তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধান অর্জন সম্ভব।
আন্তঃজাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে আশাবাদ
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আমাদের সব দরজা খোলা রয়েছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি, যাতে মিয়ানমার সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো যায়।”
তিনি রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট ও একতাবদ্ধ অবস্থান উপস্থাপন জরুরি। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আপনাদের কথা তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এতে আপনারা নিজ ভূমিতে নিরাপদে ফিরতে পারবেন বলে আশা করছি।”
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে, যা বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “এই সম্মতি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।”
বাংলাদেশের মানবিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির বার্তা
আলোচনাসভায় বক্তব্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশের মানবিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিকটি বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সব ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশে এই সময়টি উৎসবের, সম্প্রতি আমরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছি, আজ রাখাইন সম্প্রদায়ের সাংগ্রেং উৎসবে এসেছি। এটাই আমাদের দেশের সৌন্দর্য। এখানে সম্প্রীতির ঐতিহ্য আমাদের গর্বের অংশ।”
এই আলোচনাসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ড. খলিলুর রহমান শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু নয়, বরং জাতিগত ঐক্য, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের গুরুত্বও তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাখাইন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশের মানবিক এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালের আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা ঢল আজও থামেনি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্মম দমন-পীড়নের মুখে প্রায় দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদেরকে সাময়িক আশ্রয় দিলেও, এত বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থায়ী বসবাস দেশের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক ভারসাম্যে বড় প্রভাব ফেলছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এই বাস্তবতাকেও স্বীকার করে বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি বড় বোঝা। তাই আমরা এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও সম্মানজনক সমাধান চাই। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমরা চাই, রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদে স্বদেশে ফিরতে পারেন। ঈদের আগেই তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অগ্রগতি সাধনের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।”
প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা: সময়ের দাবি
বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করে আসছে। বিভিন্ন সময় চীন, জাপান, ভারতসহ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যস্থতায় কয়েক দফা চুক্তি হলেও প্রত্যাবাসন কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামরিক শাসনের প্রভাবের কারণে এই প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ড. খলিলুর রহমান বলেন, “আমরা চাই মিয়ানমারে একটি নিরাপদ, টেকসই এবং মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত হোক। প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চয়তা ছাড়া এ প্রক্রিয়া এগোবে না। তাই আমরা শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নয়, বরং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছি।”
বাংলাদেশের আশাবাদ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR) সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসন টেকসই হবে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছে আন্তর্জাতিক মহল। বিশেষ করে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার সম্মতিকে অনেকেই সমাধানের পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করছেন।
ড. খলিলুর রহমান বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের অবস্থান সবসময়ই মানবিক ও শান্তিপূর্ণ। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট বাংলাদেশের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে। তাই প্রত্যাবাসন ছাড়া এই সমস্যার টেকসই সমাধান নেই। আমরা সকল পক্ষের সহযোগিতায় এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ অবসান চাই।”
উপসংহার
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা আশা করছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট — প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সবদিক থেকেই প্রস্তুত। এখন দরকার মিয়ানমারের সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জোরালো ভূমিকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট নিরসনের জন্য আলোচনার দরজা খোলা রাখা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধারাবাহিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টাই হতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র বাস্তব সমাধান।