কাপ্তাইয়ে ২২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, নতুন রেকর্ড স্থাপন

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে এক নতুন সফলতার সাক্ষী হলো কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে এই কেন্দ্রে পাঁচটি ইউনিট একসাথে চালু রেখে ২২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে, যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ও রেকর্ড
কাপ্তাই কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট থেকে সর্বমোট ২২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে,
- প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট থেকে প্রতিটি ৪৬ মেগাওয়াট করে মোট ৯২ মেগাওয়াট,
- তৃতীয় ইউনিট থেকে ৪৯ মেগাওয়াট,
- চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিট থেকে প্রতিটি ৪০ মেগাওয়াট করে মোট ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
এর আগেও, চলতি বছরের ২০ জুলাই রাতে এই পাঁচটি ইউনিট একযোগে চালু করার পর ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি হয়েছিল।
কাপ্তাই লেকের পানি ও উৎপাদন ক্ষমতা
কাপ্তাই লেক বাংলাদেশের বৃহত্তম কৃত্রিম জলাধার। লেকটির পানির উচ্চতা ও পরিমাণ সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ২২ জুলাই সকাল ৯টা পর্যন্ত কাপ্তাই লেকের পানি স্তর ছিল ১০০.১৭ ফুট মিনাস সি লেভেল, যা রুলকার্ভ অনুযায়ী পানির আদর্শ স্তর ৮৭.৩৬ ফুটের অনেক ওপরে। কাপ্তাই লেকের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ১০৮ ফুট মিনাস সি লেভেল। এ অবস্থায় পাঁচটি ইউনিট একসঙ্গে চালু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম এবং বৃষ্টিপাতের প্রভাব
এই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩0 মেগাওয়াট। তবে পানি লেভেলের ওপর নির্ভর করে পাঁচটি ইউনিট একসঙ্গে চালু করার সুযোগ সবসময় থাকে না। চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে কাপ্তাই লেকে পানি স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
- ২ জুন থেকে চারটি ইউনিট চালু করা হয়েছিল।
- ৯ জুলাই রাত ৮টায় পাঁচটি ইউনিট একসাথে চালু করে ২১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
- ১৪ জুলাই থেকে পাঁচটি ইউনিট থেকে ২১৮ মেগাওয়াট এবং
- ২০ জুলাই পাঁচটি ইউনিট থেকে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড তৈরি হয়।
এবার ২২ জুলাই ২২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্ণফুলী কেন্দ্রের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জাতীয় গ্রিডে সংযুক্তি
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালিত হয়। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকে এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলীরা জানান, উচ্চ পানির মাত্রা ও কার্যকর প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই ধরনের উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র: দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবদান অপরিসীম। দেশের প্রথম পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে ১৯৬২ সালে স্থাপন এই কেন্দ্রটি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভিত্তি শক্ত করেছে। বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ মিশ্রণে এর অংশগৃহীত ক্ষমতা প্রায় ৫ শতাংশের বেশি।
কর্ণফুলী কেন্দ্রের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
কেন্দ্রটি মোট পাঁচটি ইউনিট নিয়ে গঠিত, যার প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট।
- ইউনিট ১ ও ২-এর ক্ষমতা সমান,
- ইউনিট ৩-এর উৎপাদন সামান্য বেশি,
- ইউনিট ৪ ও ৫-এর উৎপাদন সামান্য কম।
এই ইউনিটগুলো পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ইউনিটগুলোর সঠিক সমন্বয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে উচ্চ উৎপাদন।
কাপ্তাই লেক ও পরিবেশগত গুরুত্ব
কাপ্তাই লেক শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং রাঙামাটি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি স্থানীয় কৃষি, মৎস্যচাষ এবং পর্যটন শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পানি লেকের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য।
ভবিষ্যতে কর্ণফুলী কেন্দ্রের পরিকল্পনা
বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কর্ণফুলী কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চলছে। আধুনিকায়ন ও ইউনিটগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামী বছরগুলিতে উৎপাদন ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
সংক্ষেপে
- কাপ্তাই কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।
- পানি লেকের পানি মাত্রার বৃদ্ধির ফলে পাঁচটি ইউনিট একসঙ্গে চালু করে সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
- উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালিত হচ্ছে, দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে অবদান রাখছে।
- কেন্দ্রটি দেশের বিদ্যুৎ মিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং ভবিষ্যতে আরও আধুনিকায়নের মাধ্যমে ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।