বাংলাদেশে সোনার দাম আকাশছোঁয়া, অথচ দুবাই ও ভারতে কেন কম

বর্তমানে বাংলাদেশের সোনার বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এক ভরি সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ৬০০ টাকা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমেছে, তারপরও ২২ ক্যারেট সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকায়, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যের সোনার হাব হিসেবে পরিচিত দুবাইয়ে একই মানের সোনার দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এমন পার্থক্য?
কোথায় কত দাম?
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী,
- দুবাইয়ে ২২ ক্যারেট সোনার ভরি ৪২১৭ দিরহাম, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা।
- ভারতে একই মানের সোনার ভরি ১ লাখ ৬ হাজার ৯৫৯ রুপি, অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৮ টাকা।
- অথচ বাংলাদেশে ২২ ক্যারেট সোনার ভরি বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৬৯ হাজার টাকায়।
এর মানে, দুবাইয়ের চেয়ে বাংলাদেশে সোনার দাম প্রায় ২৯ হাজার ৫০০ টাকা বেশি, আর ভারতের তুলনায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেশি।
কেন এত পার্থক্য?
এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ:
- বাণিজ্যিক আমদানি প্রায় বন্ধ
বাংলাদেশে সোনার বাজার নির্ভর করে ‘ব্যাগেজ রুল’-এর আওতায় আসা ব্যক্তিগত সোনার ওপর। বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির লাইসেন্স থাকলেও বিদেশি মুদ্রার সংকট, অনুমতির জটিলতা ও বেশি ভ্যাটের কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। - চোরাচালান ও অস্বচ্ছ বাজারব্যবস্থা
বেশিরভাগ সোনা আসে অবৈধ পথে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ও শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ৭ মাসে ১৪৩ কেজি অবৈধ সোনা উদ্ধার করেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া পুরনো গয়না গলিয়ে চাহিদা মেটানো হয়। - বাজুসের অস্বচ্ছ মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) দাম নির্ধারণ করে থাকলেও তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সমিতির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান বলছেন, “খাঁটি সোনার সঙ্গে সামান্য মুনাফা যোগ করেই দাম ঠিক করা হয়।” কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নেই।
দাম বাড়ছে কেন?
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সোনার চাহিদা বেড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
- ২০২০ সালের আগস্টে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ২ হাজার ৭০ ডলার।
- ২০২৫ সালের মার্চে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০০ ডলার, এবং বিশ্লেষকদের মতে তা ৪ হাজার ডলার ছাড়াতে পারে।
অতীতে কত ছিল?
- ১৯৭১ সালে: সোনার ভরি ছিল মাত্র ১৭০ টাকা।
- ২০০০ সালে: ৬৯০০ টাকা।
- ২০১০ সালে: ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা।
- ২০২৫ সালের এপ্রিল: সর্বোচ্চ রেকর্ড ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
অর্থাৎ, স্বাধীনতার পর সোনার দাম বেড়েছে ৯৯৩ গুণ।
কেনার বদলে বিক্রি
বর্তমানে অনেক সাধারণ মানুষ গয়না কেনা কমিয়ে বিক্রি করছেন।
উদাহরণস্বরূপ:
- যদি কেউ ৫ বছর আগে এক ভরি গয়না কিনে থাকেন ৬৯,৮৬৭ টাকায়, এখন তা বিক্রি করলে পাবেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা—যদিও ১৭% ওজন বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারিত হয়।
বাজার সংকুচিত, রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ
বছরে দেশে প্রায় ২০-৪০ টন সোনার চাহিদা থাকলেও, মাত্র ১০% পুরোনো গয়না দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ হয়।
বাকি আসে ব্যাগেজ রুল বা চোরাচালানের মাধ্যমে, যার ফলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সমাধানের পথ কী?
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশের সোনার বাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা সরবরাহ ব্যবস্থার অনানুষ্ঠানিকতা।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর মাধ্যমে দাম নির্ধারণের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ কী?
এটি একটি পদ্ধতি, যেখানে শেয়ারবাজারের মতো পণ্য—যেমন সোনা—কাগজে বা ডিজিটালি কেনাবেচা হয়।
মূল পণ্যটি গুদামে থাকলেও ক্রেতা বিক্রেতারা নির্দিষ্ট দামে লেনদেন করতে পারেন, যা বাজারে স্বচ্ছতা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে সোনার উচ্চমূল্য শুধু ক্রেতাদের জন্য নয়, সরকারের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চোরাচালান ও অস্বচ্ছ ব্যবসার কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব হারাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি হলো:
- বাণিজ্যিক আমদানিকে সহজ করা,
- ট্যাক্স হ্রাস ও প্রক্রিয়া দ্রুত করা,
- এবং সোনার বাজারকে আনুষ্ঠানিক ও স্বচ্ছ করা।
তা না হলে, ভবিষ্যতে মধ্যবিত্তের কাছে সোনা শুধু ‘স্বপ্নের অলংকার’ হয়েই থেকে যাবে।