সশস্ত্র বাহিনী ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’, ভারতকে হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে এ বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে ভারতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্ত জবাব’ দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে।
হামলার প্রেক্ষাপট
২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামের বৈসারন এলাকায় একটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে দুজন বিদেশি পর্যটক ছিলেন—একজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের এবং অপরজন নেপালের নাগরিক। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যিনি ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামেও পরিচিত। গোষ্ঠীটি দাবি করেছে, লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিরা সাধারণ পর্যটক নন, বরং ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ।
পাকিস্তানের সিনেট প্রস্তাব
পাকিস্তানের সিনেটে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভারতের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। প্রস্তাবে হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সংযোগ নেই বলে দাবি করা হয়েছে। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সিনেট অধিবেশনে বলেন, “ভারত কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এগুলো ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য।” তিনি ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোকে ‘অসতর্ক’ ও ‘আবেগপ্রবণ’ বলে সমালোচনা করেন।
দার আরও জানান, জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, সার্ক ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে হবে। এই পদক্ষেপ ভারতের পাকিস্তানি নাগরিকদের বিরুদ্ধে নেওয়া অনুরূপ সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ২৬টি দেশকে এ বিষয়ে ব্রিফ করেছে এবং বাকিদের শিগগিরই ব্রিফ করা হবে।
ভারতের পদক্ষেপ ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার কমিটির এক জরুরি বৈঠকের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি বড় পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা: ভারত একতরফাভাবে এই চুক্তি স্থগিত করার �விஸ্তুক্তা: এই সংঘাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতীয় ভিসা বাতিল করা হয়েছে এবং তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- ওয়াঘা-অটারি সীমান্ত বন্ধ: এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশকারীদের ১ মে’র মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে হবে।
- পাকিস্তানি হাইকমিশনের কর্মকর্তা সংখ্যা হ্রাস: নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে।
- সামরিক উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার: পাকিস্তান হাইকমিশনের সামরিক উপদেষ্টাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে।
- সার্ক ভিসা বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
পাকিস্তান এই পদক্ষেপগুলোর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইসহাক দার জানান, সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করা যায় না, কারণ এটি দুই দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কার্যকর। তিনি এই চুক্তি স্থগিতের হুমকিকে ‘যুদ্ধের শামিল’ বলে অভিহিত করেন, যা ২৪ কোটি পাকিস্তানির জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ব্রিটিশ স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। তিনি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ প্রকাশ করার আহ্বান জানান। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ ঘোষণা করে তিনি ভারতকে অতীতের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
এক্স-এ পোস্ট অনুসারে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলো উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, এবং সামরিক বাহিনীর সব শাখা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর ‘শূন্য সমঝোতা’ নীতির প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই সংকটের গুরুত্ব উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের মতে, ভারতের একতরফা পদক্ষেপগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। তিনি দাবি করেন, ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছে, যার জন্য পাকিস্তান ‘সমপর্যায়ের জবাব’ দেবে।
কাশ্মীরের প্রেক্ষাপট
কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। ২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। এই সিদ্ধান্তের পর থেকে কাশ্মীরে উত্তেজনা বেড়েছে। ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ গোষ্ঠীটি এই নীতির বিরোধিতা করে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, এই গোষ্ঠী পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও হিজবুল মুজাহিদিনের সঙ্গে যুক্ত।
নিরাপত্তা ব্যর্থতার সমালোচনা
পহেলগাম হামলার পর ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছিল, কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কমে এসেছে এবং ২০২৪ সালে ৩৫ লাখ পর্যটক এই অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা এই দাবির বিপরীতে গেছে। পদ্মশ্রী প্রাপক কার্তিক মহারাজ বলেন, “৩৭০ ধারা বাতিলের পর ভেবেছিলাম শান্তি ফিরবে। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল প্রাক্তন সেনাকর্মীদের কাশ্মীরে বসবাসের ব্যবস্থা করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া।”