বিশ্ব

ট্রাম্পের শুল্কের প্রতিবাদে ভারতজুড়ে মার্কিন পণ্য বয়কট

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদে ভারতে চলছে মার্কিন পণ্যের ব্যাপক বর্জন আন্দোলন। ম্যাকডোনাল্ডস, কোকা-কোলা, অ্যামাজন ও অ্যাপলসহ বহু মার্কিন ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনার আগুন জ্বলছে।

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পণ্যের বয়কটের ডাক দিয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ। ম্যাকডোনাল্ডস, কোকা-কোলা, অ্যামাজন, অ্যাপল সহ বহু বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানির পণ্য এখন সোশ্যাল মিডিয়া ও বাস্তব জীবনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।

বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ভারত আজ দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ভোক্তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তাই মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোর জন্য ভারতের বাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে এসব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ব্যবহার অনেকের কাছে আধুনিকতার ও আর্থিক উন্নতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হলেও, শুল্ক বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে।

ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যের আধিপত্য এবং তার পেছনের গল্প

ভারতে হোয়াটসঅ্যাপ, ডোমিনোজ, পেপসি-কোকা-কোলা, অ্যাপল, স্টারবাকসের মতো মার্কিন ব্র্যান্ডের বাজার অনেক বড় এবং শক্তিশালী। হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারী সংখ্যায় ভারত বিশ্বের শীর্ষে। ডোমিনোজ দেশের সর্বাধিক রেস্টুরেন্ট চেইনের মধ্যে অন্যতম। পেপসি এবং কোকা-কোলা প্রায় প্রতিটি দোকানের তাক দখল করে রেখেছে। নতুন অ্যাপল স্টোর বা স্টারবাকসের সামনে মানুষ দীর্ঘ লাইন করেন অফার উপভোগ করার জন্য।

তবে, ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দেশীয় পণ্য বর্জন এবং মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক জোরালো হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারতীয় উদ্যোগ ও ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারণা

ভারতীয় স্টার্টআপ ও ব্যবসায়িক নেতারা দেশীয় পণ্য ও প্রযুক্তির প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ওয়াও স্কিন সায়েন্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মনীশ চৌধুরী লিঙ্কডইনে একটি ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘মেড ইন ইন্ডিয়াকে’ বিশ্বজুড়ে একটি আবেগপ্রবণ ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ তুলে ধরেন, যেখানে খাদ্য ও সৌন্দর্যবর্ধক পণ্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়।

তাঁর কথায়, “আমরা হাজার হাজার মাইল দূরের পণ্যের জন্য লাইন ধরে গর্ব করে অর্থ খরচ করেছি, অথচ নিজেদের প্রস্তুতকারকদের জন্য আমাদের দেশেই মনোযোগ পাওয়া উচিত।”

এছাড়াও, ‘ড্রাইভ ইউ’ নামে একটি ড্রাইভার সার্ভিসের সিইও রাহম শাস্ত্রী লিঙ্কডইনে লিখেছেন, “ভারতে নিজস্ব টুইটার, গুগল, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ থাকা উচিত, যেমন চীনের আছে।” তিনি দেশের প্রযুক্তি সার্বভৌমত্ব ও স্বনির্ভরতার উপর জোর দিয়েছেন।

ভারতের আইটি সেক্টর: গ্লোবাল প্লেয়ার

যদিও মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক চলছে, ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠান যেমন টিসিএস, ইনফোসিস আন্তর্জাতিক বাজারে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্বব্যাপী সেবা দিয়ে ভারতের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।

রোববার বেঙ্গালুরুর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ভারতীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারের জন্য পণ্য তৈরি করছে। এখন দেশের প্রয়োজনকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এসেছে।” তবে মোদি এই বক্তব্যে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম উল্লেখ করেননি।

মার্কিন পণ্যের বর্জন আন্দোলন ও রাজনৈতিক প্রভাব

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সমর্থিত স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে মার্কিন পণ্য বয়কটের প্রচারণা চালাচ্ছে। সংগঠনের সহ-সমন্বয়ক অশ্বিনী মহাজন জানান, এই বয়কট এখন জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তারা হোয়াটসঅ্যাপে দেশীয় পণ্যের একটি তালিকা প্রচার করছেন যেখানে বিদেশি পণ্যের বিকল্প হিসেবে ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলোর নাম রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ‘বিদেশি ফুড চেইন বর্জন করুন’ শিরোনামে প্রচারণা চলছে, যেখানে ম্যাকডোনাল্ডসসহ অনেক মার্কিন রেস্টুরেন্ট ব্র্যান্ডের লোগো দেখা যায়।

ভারতের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

উত্তর প্রদেশের লখনউতে ম্যাকডোনাল্ডসে কফি খাচ্ছিলেন রজত গুপ্ত, যিনি ৩৭ বছর বয়সী। তিনি শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বিগ্ন নন এবং বলেছেন, “আমার জন্য ৪৯ রুপির কফি দারুণ সাশ্রয়ী। শুল্ক কূটনীতির বিষয়, আমার ম্যাকপাফ আর কফিকে এতে টেনে আনা উচিত নয়।”

এমনটা প্রমাণ করে, যদিও রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে পণ্য বর্জন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ও ভারতের প্রতিক্রিয়া: সামগ্রিক বিশ্লেষণ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে স্পর্শ করেছে। এতে ভারতে মার্কিন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে এবং আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই শুল্ক আরোপের কারণে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ বাড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সংযোগ দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

দেশীয় পণ্য ও ব্র্যান্ডকে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এবং ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে আরো জোরদার করেছে। অনেক ব্যবসায়ী, স্টার্টআপ এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এখন নিজস্ব উদ্ভাবন ও উৎপাদনে মনোযোগ বাড়াচ্ছে।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় বাজারে মার্কিন পণ্যের বিক্রয় কিছুটা কমতে পারে। তবে বিশ্বের বৃহত্তম ডেমোক্র্যাসির বাজারে এমন বর্জন আন্দোলনের ফলে অন্য বিদেশি ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে পারে।

আরেক দিকে, ভারতের নিজস্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রযুক্তি স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও নজর পড়ছে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে পেরেছে, ভারতের ক্ষেত্রেও সেই পথচলা শুরু হয়েছে।

সারসংক্ষেপ:

  • ট্রাম্পের ৫০% অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রতিবাদে ভারতে মার্কিন পণ্যের বয়কট শুরু হয়েছে।
  • ম্যাকডোনাল্ডস, কোকা-কোলা, অ্যামাজন, অ্যাপলসহ মার্কিন ব্র্যান্ড সমালোচনার মুখে।
  • দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উৎসাহ বেড়ে চলছে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ আন্দোলন।
  • ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন ব্যবসায়ী আত্মনির্ভরতার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
  • মার্কিন শুল্ক আরোপ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
  • সাধারণ মানুষের মধ্যে বয়কট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
  • ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত হচ্ছে।

MAH – 12259 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button