ট্রাম্পের শুল্কনীতির ধাক্কায় কমছে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা

বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তেজনায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এরই মধ্যে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক এবং ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) সতর্ক করেছে, এই উত্তেজনার কারণে ২০২৫ ও ২০২৬ সালে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা কমে যেতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের প্রভাবেই এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চাহিদা বাড়বে, কিন্তু পূর্বাভাসের তুলনায় কম
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওপেক জানিয়েছে,
- ২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে তেলের দৈনিক চাহিদা ১৩ লাখ ব্যারেল বাড়তে পারে।
- ২০২৬ সালে বাড়তে পারে ১২ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল।
তবে আগের পূর্বাভাসের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল কম হবে এই বৃদ্ধির হার।
অন্যদিকে, আইইএ’র মতে,
- ২০২৫ সালের জন্য দৈনিক তেলের চাহিদা বাড়বে ৭ লাখ ৩০ হাজার ব্যারেল,
যেখানে আগের পূর্বাভাস ছিল ১০ লাখ ৩০ হাজার ব্যারেল।
কেন কমছে চাহিদা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাণিজ্যযুদ্ধ ও শুল্ক বৃদ্ধি।
বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এখন সরাসরি বাণিজ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের উপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপ করেছে, যার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীনও কিছু নিষেধাজ্ঞামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এ ধরনের পরিবেশে বিশ্ববাণিজ্য হোঁচট খায়। শিল্পকারখানা ও পরিবহন খাত স্লথ হয়ে পড়ে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে তেলের ওপর নির্ভরশীল খাতে। এর ফলে, তেলের ব্যবহার কমে যায়, বিশেষ করে ভারী শিল্প ও রপ্তানিনির্ভর দেশগুলোতে।
মূল্যপতনও উদ্বেগজনক
ওপেক জানিয়েছে, এই চাহিদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে তেলের দামও ব্যাপকভাবে কমেছে।
বিশেষ করে ২ এপ্রিল ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর,
- চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তেলের দাম।
- ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৬০ ডলারে নেমে আসে।
অথচ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর,
- তেলের দাম একসময় পৌঁছেছিল ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলার।
- সেই বছর গড় দাম ছিল ১০০ ডলার।
এরপর ২০২৩ সালে কমে আসে ৮০ ডলার এবং ২০২৪ সালে গড় দাম দাঁড়ায় ৭০ ডলারের আশেপাশে। আর বর্তমানে,
- ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ৬৬ ডলার।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ছাপ ফেলছে
ওপেক শুধু তেলের চাহিদা নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও কমিয়ে ধরেছে।
- ২০২৫ সালের পূর্বাভাস ছিল ৩.১ শতাংশ,
কিন্তু তা কমিয়ে ধরা হয়েছে ৩ শতাংশ। - ২০২৬ সালের পূর্বাভাসও ৩.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩.১ শতাংশ।
অর্থাৎ, বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে এই পূর্বাভাস।
ওপেকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বছরের শুরুতে অর্থনীতি ছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে একাধিক দেশ শুল্ক আরোপ করছে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছে, তাতে স্বল্পমেয়াদে হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।”
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র— কারণ এই দুই দেশের তেলের ব্যবহার সর্বোচ্চ।
সঙ্গে সঙ্গে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো যেমন ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ এই দেশগুলো শিল্পোন্নয়নের জন্য এখনও জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে
বিশ্বব্যাপী বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, যদি ট্রাম্প প্রশাসনের এই কঠোর শুল্কনীতি অব্যাহত থাকে এবং অন্যান্য দেশ পাল্টা জবাব দিতে থাকে, তাহলে বাণিজ্য উত্তেজনা আরও গভীর হবে।
এর ফলে:
- বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে মন্থর হয়ে পড়তে পারে।
- বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা ও দাম আরও নিম্নমুখী হতে পারে।
- জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পেতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব নয়, বরং বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওপেক এবং আইইএ-এর মতো সংস্থা এই সংকেতগুলো দিয়ে বিশ্ব নেতাদের প্রতি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে, যেন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা যায়।
বিশ্ব বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন সংলাপ, শুল্ক নীতির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার এবং সহযোগিতাপূর্ণ বাণিজ্য কৌশল— না হলে শুধু জ্বালানি নয়, সার্বিক বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেতে পারে।