বিশ্ব

ভারত-পাকিস্তান কি যুদ্ধের পথে? উত্তেজনার শীর্ষে দুই দেশের সম্পর্ক

ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ, উসকানিমূলক বক্তব্য এবং সামরিক প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: তবে কি পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে?

পেহেলগামের হামলার পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

পেহেলগামে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলায় একাধিক প্রাণহানির ঘটনায় ভারতের অভ্যন্তরে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব চরমে উঠেছে। ভারতের সব বিরোধী দল মোদি সরকারকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কার্যত ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানকেও দেখা যাচ্ছে সতর্ক এবং আক্রমণাত্মক অবস্থানে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, “কাশ্মির ইস্যু নিয়ে ভারতের অযৌক্তিক আচরণ এবং সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে গুরুতর উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে। যুদ্ধের অভিঘাত কেবল ভারত ও পাকিস্তানেই নয়, গোটা বিশ্বেই পড়বে।”

পানি চুক্তি স্থগিত: উত্তেজনায় নতুন মাত্রা

বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি দীর্ঘদিন ধরেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের একটি সংবেদনশীল ইস্যু। ভারত সেই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের সংকট আরও গভীর করেছে। এর জের ধরে পাকিস্তানের ভেতর থেকে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছেন, “ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করছে নিজেদের সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতে। আমরা কোনো অপ্রয়োজনীয় সংঘাতে জড়াতে চাই না। তবে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”

পাকিস্তানের অবস্থান: সংযম, কিন্তু প্রস্তুতিও

পাকিস্তান স্পষ্ট করেছে যে তারা যুদ্ধ চায় না, বরং সমস্যা সমাধানে সংযম দেখাতে চায়। তবে আত্মরক্ষার স্বার্থে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি আরও বলেন, “প্রত্যেক সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানকে দায়ী করা একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের উচিত সংযম দেখানো এবং কূটনৈতিক মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা।”

ভিসা বাতিল এবং নাগরিক প্রত্যাবর্তন

পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে যখন ভারত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে দেয়। এর ফলে ভারতে থাকা পাকিস্তানিরা দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যেতে শুরু করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি ডেকে আনতে পারে।

আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ

পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অনেকেই বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাতেও গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশেষ করে উভয় দেশের পরমাণু অস্ত্রের মজুদ এবং আগ্রাসী কৌশল—এগুলি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে শুধু সীমান্ত অঞ্চল নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট তৈরি হবে।

যুদ্ধের আশঙ্কা: বাস্তবতা নাকি রাজনৈতিক চাপ?

অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুদ্ধের শঙ্কা যতটা প্রচার করা হচ্ছে, তা কিছুটা রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশলও হতে পারে। মোদি সরকার বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যুতে সমালোচনার মুখে রয়েছে। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়ে জনসমর্থন নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতে পারে।

তেমনি পাকিস্তানও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই কোনো রকম যুদ্ধের ঝুঁকি দেশটির জন্যও মারাত্মক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পরমাণু শক্তির ঝুঁকি: সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন

উভয় দেশের পরমাণু অস্ত্রের মজুদ এবং ইতিহাসের দিকে তাকালে যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পর থেকে উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। তাই সামান্য একটি সংঘাতও বড় ধরনের যুদ্ধ বা মারাত্মক পরমাণু বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে।

জাতিসংঘ এবং বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর উচিত উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কারণ পরিস্থিতি যে কোনো মুহূর্তে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে।

বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছালেও সরাসরি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। দুপক্ষই উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক বক্তব্যের পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। তবে যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে সামান্য উত্তেজনাও ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব কেবল এই অঞ্চলেই নয়, ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে।

এখনই সময় দুই দেশের নেতৃত্বের সর্বোচ্চ সংযম ও দূরদর্শিতার। যুদ্ধ নয়, শান্তি ও আলোচনাই হতে হবে সমাধানের একমাত্র পথ।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button