রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কী আলাপ হলো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

তিন দিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশে এসেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। ঢাকায় এসে তিনি শুধু সরকারি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নয়, বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে উঠে এসেছে আঞ্চলিক সহযোগিতা, সার্কের ভবিষ্যৎ, প্রতিরক্ষা খাত, বাণিজ্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নানা অমীমাংসিত ইস্যু।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের সারাংশ
শনিবার ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের আমন্ত্রণে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি–এর প্রতিনিধিরা ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে নেতারা জানান, আলোচনায় মূলত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে।
জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার এবং অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক ইস্যু সমাধানে দুই পক্ষের মধ্যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সার্ককে আবার কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তাও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে।
সার্ক ইস্যু ও আঞ্চলিক সহযোগিতা
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দার জানান, ভারতীয় বাধার কারণে সার্ক অকার্যকর হয়ে আছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় পক্ষ মনে করে, এ অঞ্চলের শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাড়াতে সার্ককে পুনরায় সক্রিয় করা জরুরি।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, নদী ও পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সংকট নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দুই দেশই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে।
অর্থনীতি ও বাণিজ্যে সম্ভাবনা
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিকটিও আলোচনায় প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করেছে। পাকিস্তানও এই খাতে অগ্রগতি করার চেষ্টা করছে। আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে সহযোগিতা, সরাসরি জাহাজ চলাচল, এবং আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পারস্পরিক বিনিময়ের প্রস্তাবও উঠে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং প্রতিরক্ষা খাতের সহযোগিতাও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রসঙ্গ
বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গও উঠে আসে। যদিও সেটি মূল আলোচনার বিষয় ছিল না, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা নির্বাচন ঘিরে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। ইসহাক দার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ
আলোচনায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গও এসেছে। জামায়াতসহ কিছু দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, অতীতের ইতিহাসকে স্বীকার করেই ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে হবে। এ নিয়ে দার কূটনৈতিকভাবে সংযত অবস্থান নিলেও, তিনি বলেন, পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া উচিত।
ভবিষ্যৎ চুক্তি ও প্রত্যাশা
সরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকে বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা বিলোপ চুক্তি বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কয়েকটি সমঝোতাও স্বাক্ষর হতে পারে।
বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের এই সফর বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন পর দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের ভূমিকাও কম নয়। তাই, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে এ সফর গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে।
ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফর শুধু আনুষ্ঠানিক কূটনীতি নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপচারিতা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর ইঙ্গিত বহন করছে। এখন প্রশ্ন হলো, আলোচনায় উত্থাপিত বিষয়গুলো কতটা বাস্তবায়ন হবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কতটা এগোবে। সময়ই তা প্রমাণ করবে।
এম আর এম – ১০০০, Signalbd.com