স্কুইড গেম ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র: এক ভয়াবহ রূপকের আয়নায় বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি

দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘স্কুইড গেম’ দেখে প্রথমে মনে হতে পারে, এটি নিছকই একটি ডিসটোপিয়ান থ্রিলার—বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী একদল ঋণগ্রস্ত মানুষের গল্প। তবে একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, এটি শুধু একটি সিরিজ নয়; বরং সমাজব্যবস্থার এক নির্মম ও নগ্ন প্রতিচ্ছবি। আর সেই প্রতিচ্ছবিই যেন বাস্তবে প্রতিফলিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে গণতন্ত্রের নামে চলমান নির্বাচন-নাটকে।
গণতন্ত্রের মুখোশে মৃত্যুর খেলা
স্কুইড গেমে যেমন দেখা যায়, অর্থের লোভে ও জীবন বাঁচানোর তাগিদে একদল মানুষ নিজেদের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও প্রতিনিয়ত মানুষের বিশ্বাস, মানবিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে চলছে এক নির্মম খেলা। এই খেলার পেছনে রয়েছে এলিট শ্রেণি ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের জোট। এখানে নির্বাচন একটি প্রতীকমাত্র—গণতন্ত্রের মোড়কে চালানো হয় এক সুপরিকল্পিত ‘প্রহসন’।
স্কুইড গেমে ‘ফ্রন্ট ম্যান’ যেমন পুরো খেলাটি পরিচালনা করে মুখোশধারীদের হয়ে, তেমনি আমাদের রাজনীতির পেছনে থাকা এই ‘ফ্রন্ট ম্যানরাও’ সাধারণত রাজনৈতিক নেতারা, যারা এলিট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পুরো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানেও ভোট নেওয়ার ভান চলে, কিন্তু জনগণের মতের প্রতিফলন তাতে ঘটে না। বরং তাদের বিভক্ত, বিভ্রান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়।
ভোটের নামে বিভাজন ও ধোঁকা
স্কুইড গেমের দ্বিতীয় মৌসুমে দেখানো হয়, খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফ্রন্ট ম্যান নিজেই নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে। একই কৌশল বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতেও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, জাতিগত পরিচয়—সবকিছু দিয়েই জনগণকে বিভক্ত করে রাখা হয়, যেন তারা কখনোই ঐক্যবদ্ধ না হয়।
এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও দেখা যায়, ধর্মশিক্ষাকে বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একই শ্রেণিতে পড়া দুই শিক্ষার্থী কেবল ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা ক্লাসে যায়। অথচ যৌথভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ শেখানো যেত, যাতে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সম্মানবোধ গড়ে ওঠে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা: বাণিজ্যের খেলাঘর
স্বাস্থ্যখাতও স্কুইড গেমের আরেকটি প্রতিফলন। যেমন খেলোয়াড়েরা নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে অর্থের জন্য লড়াই করে, তেমনি বাংলাদেশে একজন রোগীও নিরুপায়ভাবে ‘জীবনের জন্য লড়াই’ করে চলেন। মহামূল্যবান ওষুধ, পরীক্ষার খরচ, চিকিৎসকের ফি—সব কিছু যেন এক নির্মম বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন মেডিকেল কলেজ স্থাপন, প্রশ্নফাঁস, এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে। চিকিৎসা যেন মানুষের অধিকার নয়, বরং একটি উচ্চমূল্যের পণ্য, যা কিনতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
স্কুইড গেম ও বাংলাদেশ: এক সূক্ষ্ম সাদৃশ্য
স্কুইড গেমের মূল দর্শন দাঁড়িয়ে আছে লোভ, ভীতি ও বিভ্রান্তি তৈরির ওপর। প্রতিটি খেলার আগে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভান করা হয়—ভোট নেওয়া হয়। কিন্তু আসল সিদ্ধান্ত নিয়েই রাখা থাকে। ঠিক তেমনই বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের পূর্ব নির্ধারিত খেলার মঞ্চায়ন হয়, যেখানে জনগণ শুধুই দর্শক কিংবা গিনিপিগ।
প্রতি নির্বাচনের আগে জনগণকে নানা রকম ভয় দেখানো হয়—চাকরি যাবে, সহিংসতা হবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার কখনো লোভ দেখানো হয়—ভাতা, ত্রাণ, সুযোগ-সুবিধা, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। এসবই যেন জনগণকে খেলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি মাত্র।
রাজনীতিবিদেরা কি তাহলে ‘ফ্রন্ট ম্যান’?
এই লেখায় এক গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন, রাজনীতিবিদরাই যেন স্কুইড গেমের ফ্রন্ট ম্যান। তারা নিজেরাই খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেন, আবার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেন এলিট শ্রেণির স্বার্থে।
এখানে প্রশ্ন আসে—গণতন্ত্র তাহলে কোথায়?
নির্বাচন মানেই কি গণতন্ত্র?
না হলে, নির্বাচন মানেই কি একটি ছদ্মবেশী খেলা?
প্রতিবাদের সম্ভাবনা ও দায়িত্ব
যেভাবে স্কুইড গেমের মূল চরিত্র সিওং গি-হুন শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়, সেভাবেই লেখক বলেন—জনগণ চাইলে তাদের এই ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু সেটা সহজ নয়।
সচেতনতা অর্জনের জন্য চাই শিক্ষা, ঐক্য এবং গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা।
তবে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—গণতন্ত্রের নামে যদি প্রহসন চলতেই থাকে, তবে সেটি কোনো সভ্য সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। গণতন্ত্র যেন “মজা পাওয়ার একটি এলিট আয়োজন” না হয়ে দাঁড়ায়, সেটি নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।