রাশিয়া সুদানে নৌঘাঁটি স্থাপন করবে, চুক্তি সই

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান লোহিত সাগর উপকূলে রাশিয়ার নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য ‘আর কোনো বাধা নেই’। দু’দেশের মধ্যে এই সংক্রান্ত চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে, যা সুদান সরকার নিশ্চিত করেছে। এই চুক্তির ফলে সুদান এবং রাশিয়া তাদের সামরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে যাচ্ছে, বিশেষত সুদানের কৌশলগত অবস্থানকে কেন্দ্র করে।
চুক্তি এবং সইয়ের বিস্তারিত
প্রথমে রাশিয়ার সঙ্গে নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সময়। কিন্তু ২০১৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তার ক্ষমতাচ্যুতির পর এই প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হয়। পরে সামরিক সরকারের অধীনে সুদান রাশিয়ার সঙ্গে এই চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে এবং অবশেষে গত বুধবার সুদানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইউসিফ নিশ্চিত করেছেন যে, রাশিয়ার সঙ্গে নৌঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া সুদানের লোহিত সাগর উপকূলে একটি বন্দর স্থাপন করবে, যা শুধু সুদানের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইউসিফ তার ঘোষণায় বলেন, ‘রাশিয়ার নৌঘাঁটির বিষয়ে চুক্তি নিয়ে আমরা একমত হয়েছি এবং এটা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
সুদানের নৌঘাঁটি স্থাপন: কৌশলগত গুরুত্ব
এটি এমন একটি সময়ে ঘটছে যখন হর্ন অব আফ্রিকার উপকূলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ফ্রান্সের নৌবাহিনী ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে, যার ফলে এই নৌঘাঁটি স্থাপনের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে।
এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও কৌশলগত পথ হিসেবে পরিচিত। লোহিত সাগর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহন হয়, যা এই অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যের জন্য এক অপরিহার্য জায়গা হিসেবে তুলে ধরেছে।
রাশিয়ার এই উদ্যোগের লক্ষ্য শুধু সুদানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা নয়, বরং তাদের সামরিক উপস্থিতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা। বিশেষত, সুদানের বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাগরপথের কাছে অবস্থিত, যা রাশিয়ার জন্য বৈশ্বিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও বাড়াতে পারে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা
মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং সুদানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইউসিফ এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন, যেখানে ইউসিফ এই চুক্তির বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানান যে, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের নৌঘাঁটি স্থাপন সংক্রান্ত বিষয়টি পুরোপুরি একমত হয়ে সই করা হয়েছে।
তবে লাভরভ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি এবং চুক্তির বিস্তারিত সম্পর্কে কিছুই বলেননি। তবে, সুত্র মতে, চুক্তির অনুমোদন এখন সুদানের পার্লামেন্টে প্রক্রিয়া হিসেবে রয়েছে, যা শিগগিরই পূর্ণভাবে অনুমোদিত হবে।
অতীতের চুক্তি এবং সামরিক সরকারের অবস্থান
২০১৯ সালে ওমর আল-বশিরের ক্ষমতায় থাকাকালে এই চুক্তি নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়েছিল, কিন্তু তার পতনের পর সামরিক সরকার বিষয়টি পুনঃমূল্যায়ন করে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে রাশিয়ার সঙ্গে একটি প্রাথমিক চুক্তি সই হয়েছিল, কিন্তু তখনও শেষ পর্যন্ত চুক্তি কার্যকর হয়নি।
সুদানে নতুন সামরিক সরকার শাসনভার গ্রহণের পর, তারা আবারও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে এবং এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ রূপে সই হয়। এটি সুদানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই চুক্তির ফলে আফ্রিকা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুদানের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিছু পশ্চিমা দেশ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, এই চুক্তির প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করে যে, এই ধরনের সামরিক সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষণ হতে পারে।
এদিকে, আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে কিছু দেশ রাশিয়ার এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে, বিশেষ করে যে সমস্ত দেশগুলি পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করছে, তারা এই চুক্তিকে একটি শক্তিশালী কৌশলিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
সুদানে সামরিক উপস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ
এটি নিশ্চিত যে, রাশিয়ার এই নৌঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে সুদান সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে, এই চুক্তির ফলে সুদানে বিদেশি সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে, যা অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবেশে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এবং বিশ্লেষকরা এই চুক্তিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সুদানের ভবিষ্যৎ ভূমিকা ও অঞ্চলীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব বিশ্লেষণ করছেন। বিশেষত, এই চুক্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সামরিক শক্তি এবং আফ্রিকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
উপসংহার
রাশিয়া এবং সুদানের মধ্যে নৌঘাঁটি স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি দুটি দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তবে, এই চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সুদানে বিদেশি সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চুক্তি কেবল দু’দেশের জন্য নয়, বরং গোটা আফ্রিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থানে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।