বানিজ্য

ভরিতে ৩০৩৩ টাকা বেড়েছে সোনার দাম

দেশের বাজারে আবারও বাড়ল সোনার দাম। এই দফায় প্রতি ভরি সোনার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩৩ টাকা। ফলস্বরূপ, মূল্যবান এই ধাতু আবারও নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। নতুন মূল্য অনুযায়ী, সবচেয়ে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯ টাকা। দেশের ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সোনার সর্বোচ্চ দাম।

বুধবার (১৬ এপ্রিল) বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সোনার দাম বৃদ্ধির এই তথ্য জানিয়েছে।

আরও পড়ুন:

  • ফের রেকর্ড দামে সোনা, ভরি ছাড়াল ১ লাখ ৬৩ হাজার
  • ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কমল সোনার দাম

বিজ্ঞপ্তিতে বাজুস জানায়, স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পিওর গোল্ড) দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। নতুন এই দাম আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হবে।

এর আগে, গত ১৩ এপ্রিল রাতে সোনার দাম ভরিপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৮ টাকা কমিয়ে ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকা নির্ধারণ করেছিল বাজুস। বুধবার রাত পর্যন্ত এই দামেই সোনা কেনাবেচা হয়েছে।

নতুন দাম অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) থেকে বিভিন্ন মানের সোনার দাম পরিবর্তিত হবে। ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম হবে ১ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯ টাকা। এছাড়া, ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৯৭ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৭৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৫৯ টাকা।

তবে, দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়লেও অপরিবর্তিত রয়েছে রুপার দাম। বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২২ ক্যারেটের এক ভরি রুপার দাম ২ হাজার ৫৭৮ টাকা, ২১ ক্যারেটের এক ভরি রুপার দাম ২ হাজার ৪৪৯ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি রুপার দাম ২ হাজার ১১১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি রুপার দাম ১ হাজার ৫৮৬ টাকা নির্ধারণ করা আছে। রুপার দামে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

বিশ্ববাজারে সোনার দামের ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া অস্থিরতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এই অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় আজ প্রথমবারের মতো প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩ হাজার ৩০০ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি সোনার দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছেন, যার ফলে বিশ্বব্যাপী সোনার দামে এই উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।

দেশের বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধির এই প্রভাব সাধারণ ক্রেতাদের উপর পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, যারা বিবাহ কিংবা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য সোনা কেনার পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি একটি বড় ধাক্কা। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই দামে সোনা কেনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারের দাম বাড়লে স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না। কারণ, দেশের সোনার বাজার মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওপর নির্ভরশীল। আমদানিকৃত সোনার দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় বাজারে তার প্রভাব পড়ে।

তবে, এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে চোরাচালানের প্রবণতা বাড়তে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দামের পার্থক্য বেশি থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ পথে সোনা আনার চেষ্টা করতে পারে, যা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ হতে পারে।

সরকারের পক্ষ থেকে সোনার দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। তবে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত বাজার মনিটরিং জোরদার করা এবং প্রয়োজনে নীতিগত পরিবর্তন আনা, যাতে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়।

সোনার দামের এই ঊর্ধ্বগতি শুধু ক্রেতাদের জন্যই উদ্বেগের কারণ নয়, এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, দাম বাড়লে ক্রেতারা সাধারণত কেনাকাটা কমিয়ে দেন, যার ফলে তাদের বিক্রি এবং মুনাফা কমে যেতে পারে। অনেক ছোট ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য হিমশিম খেতে পারেন।

অন্যদিকে, বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো এই পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারবেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশের জুয়েলারি শিল্পের উপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করছেন, সোনার দামের এই অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তা সহসাই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর ফলে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে অথবা দীর্ঘ সময় ধরে এই উচ্চ মূল্যেই স্থিতিশীল থাকতে পারে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, সোনা বরাবরই একটি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, বর্তমানের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি মিশ্র সংকেত দিচ্ছে। একদিকে, দাম বাড়ার সম্ভাবনা এখনো উড়িয়ে দেওয়া যায় না, অন্যদিকে, এই উচ্চ মূল্যে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। তাই, বিনিয়োগকারীদের উচিত খুব সতর্কতার সাথে এবং বাজার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই অনুযায়ী স্থানীয় বাজারে সোনার দাম নির্ধারণ করে। তাদের এই মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ এবং এতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করা হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন যে বাজুস বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে দাম নির্ধারণ করে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর।

সরকারের উচিত এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা এবং একটি সুষম নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা ক্রেতা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে।

বর্তমানে দেশের আর্থিক বাজারেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে। তার উপর সোনার দামের এই বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য একটি অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।

অনেকে মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকার যদি সোনার উপর আমদানি শুল্ক কমায়, তাহলে হয়তো স্থানীয় বাজারে দাম কিছুটা কমতে পারে। তবে, এর জন্য একটি সমন্বিত নীতিগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

জুয়েলারি শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরাও এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যদি বিক্রি কমে যায়, তাহলে অনেক কারিগর তাদের কাজ হারাতে পারেন অথবা তাদের মজুরি কমে যেতে পারে। এই শিল্পের সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত, তাই এই বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

সামগ্রিকভাবে, সোনার দামের এই উল্লম্ফন দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনে একটি বড় প্রভাব ফেলবে। সরকারের উচিত দ্রুত এই বিষয়ে নজর দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়।

অন্যদিকে, যারা সোনা কেনার পরিকল্পনা করছেন, তাদের উচিত বাজার পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া। দাম আরও বাড়তে পারে অথবা কিছুটা কমেও আসতে পারে। তাই, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

তবে, একটি বিষয় স্পষ্ট যে সোনার দাম এখন এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা অনেকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এর ফলে হয়তো সোনার বাজারের গতি কিছুটা মন্থর হতে পারে এবং মানুষ বিকল্প বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে, স্বর্ণের ব্যবসায়ীদেরও নতুন করে তাদের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। হয়তো তারা ছোট আকারের সোনার গহনা বা অন্যান্য বিকল্প পণ্য বিক্রির উপর বেশি মনোযোগ দিতে পারেন, যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এই বিষয়ে দ্রুত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে দেশের সোনার বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনে আরও প্রকট হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button