নির্বাচন ঘিরে দেশে বড় সাইবার হামলার আশঙ্কা আছে: তৈয়্যব

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাইবার হামলার আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। রোববার (৪ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে জেলা তথ্য কর্মকর্তাদের জন্য আয়োজিত ‘ডিজিটাল ভেরিফিকেশন অ্যান্ড ফ্যাক্ট চেকিং’ বিষয়ক এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, নির্বাচনের সময় ভুয়া তথ্য, গুজব এবং সাইবার হুমকির মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই হুমকি মোকাবিলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাইবার হামলার প্রকৃতি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার বক্তব্যে জানান, আগামী নির্বাচনের সময় সাইবার হামলার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হতে পারে। এই হামলাগুলোর মধ্যে থাকতে পারে ভুয়া তথ্য ছড়ানো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচার, হ্যাকিং, এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও নির্বাচনী ওয়েবসাইটে হামলা। তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময় জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই এই ধরনের হামলার মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করার চেষ্টা হতে পারে।”
তিনি আরও জানান, অতীতের নির্বাচনগুলোতে সাইবার হুমকির উদাহরণ থাকলেও আগামী নির্বাচনে এর পরিধি এবং তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে। বিশেষ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভুয়া ভিডিও এবং অডিওর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রার্থী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো সম্ভব, যা জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে।
সরকারের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ
এই হুমকি মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের সাইবার নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল ভেরিফিকেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আগারগাঁওয়ে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি এই প্রচেষ্টার একটি অংশ। এই কর্মশালায় জেলা তথ্য কর্মকর্তারা ভুয়া তথ্য শনাক্তকরণ, ফ্যাক্ট চেকিং এবং সাইবার হুমকি মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের তথ্য কর্মকর্তাদের এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। তারা জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে গুজব এবং ভুয়া তথ্যের প্রভাব কমাতে পারেন।” তিনি আরও জানান, সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ওয়েবসাইট এবং ডাটাবেসের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, সাইবার হামলা শনাক্তকরণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ।
জনগণের ভূমিকা ও সচেতনতা
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জনগণের প্রতিও সচেতনতার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “সাইবার হুমকি শুধু সরকারের মোকাবিলার বিষয় নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।” তিনি জনগণকে ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম এবং বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ মাধ্যমের উপর নির্ভর করার পরামর্শ দেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বেশ কিছু ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় উসকানি, রাজনৈতিক বিষয় বা সামাজিক ইস্যু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার এবং জনগণকে একযোগে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা
সাইবার হুমকি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব উল্লেখ করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের সময় সাইবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনগুলোতে সাইবার হামলা এবং ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে আরও সতর্ক হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা সম্ভব। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতা করছে। এই সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষতা অর্জন করে সাইবার হুমকি মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিষয়েও আলোকপাত করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি জানান, সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইনকে আরও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এছাড়া, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে নিয়মিত হুমকি বিশ্লেষণ এবং প্রতিরোধ কৌশল প্রণয়ন করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামো উন্নত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিকরা তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিরাপদে উপভোগ করতে পারবেন।” এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার, জনগণ এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
উপসংহার
আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সময়ে সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি এবং জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের সতর্কবার্তা এই বিষয়ে সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানায়। সঠিক তথ্য প্রচার, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা যায়।