বিশ্ব

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অভিন্ন অবস্থানে মস্কো-তেহরান

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অভিন্ন অবস্থানে রয়েছে মস্কো ও তেহরান। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ মঙ্গলবার ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে এই অবস্থানের কথা জানান।

লাভরভ তেহরানে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তাঁরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিসহ দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

পরে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)’ ঘিরে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা নিয়ে দুই দেশ অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে।

জেসিপিওএ: একটি বিতর্কিত চুক্তির পটভূমি

২০১৫ সালে বিশ্বের ছয় শক্তিধর দেশের সঙ্গে জেসিপিওএ সই করে ইরান। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি ও রাশিয়া। এই চুক্তির আওতায় ইরানের ওপর আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তবে শর্ত ছিল যে তেহরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখতে হবে। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন, যার ফলে চুক্তিটি কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর জো বাইডেন প্রশাসন চুক্তিটি পুনরায় কার্যকর করার চেষ্টা করলেও তাতে সফলতা আসেনি।

কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান

তেহরানে পৌঁছানোর পর লাভরভ বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক চুক্তিকে ঘিরে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা এখনো কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা সম্ভব।’

অন্যদিকে, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি সম্প্রতি বলেছেন, জাতিসংঘের চাপ থাকা সত্ত্বেও ইরান উচ্চ হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রেখেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ইরান যে হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, তা বাণিজ্যিক প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি।

তবে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গ্রোসি জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গতি কিছুটা কমিয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রতি মাসে দেশটি প্রায় সাত কেজি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে।

পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আশঙ্কা?

ইরান বহুবার দাবি করেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য, এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দিহান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রয়োজন হয়, এবং ইরানের বর্তমান কার্যক্রম সেই শঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হলে তা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযোগী হয়, এবং বর্তমান পর্যায়ে ইরানের সমৃদ্ধকরণের হার ক্রমশ সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা বিশ্ব।

গ্রোসির তেহরান সফর

আগামী মাসে আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসির তেহরান সফর করার কথা রয়েছে। এটি চলতি বছরে তার প্রথম ইরান সফর হবে, যেখানে তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক তদারকি বিষয়ে আলোচনা করবেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সফরের ফলে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

রাশিয়া-ইরান সম্পর্ক: নতুন জোটের ইঙ্গিত?

সম্প্রতি রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আর সেই শূন্যতা পূরণে তেহরানের সঙ্গে মস্কোর বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। ইরান রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, বিশেষত ড্রোন ও অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে। গত জানুয়ারিতে দুই দেশ একটি কৌশলগত চুক্তিও সই করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অভিন্ন অবস্থান ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। ইরানের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে রাশিয়ার এই সমর্থন তেহরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

পরবর্তী ধাপ কী?

বিশ্ব রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরান ও রাশিয়ার এই অবস্থান পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইতোমধ্যে ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সমর্থন থাকলে ইরান কতটা চাপে পড়বে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

আইএইএ প্রধানের তেহরান সফর এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতা যে ইরানের পারমাণবিক ইস্যুকে আরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরাপত্তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button