প্রযুক্তি

হারিয়ে যাওয়া ল্যান্ডফোন কি আবার ফিরবে আগের গতিতে

এক সময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ মাধ্যম ল্যান্ডফোন এখন প্রায় হারিয়েই গেছে। ‘টেলিফোন’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠত টিএন্ডটি লাইনের কালো রঙের সেট। যার শব্দ ছিল ঘরোয়া জীবনের অংশ। অথচ বর্তমানে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে ল্যান্ডফোন সেবার প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা উভয়ই ব্যাপকভাবে কমেছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও কল—সব মিলিয়ে এখন যোগাযোগ অনেক সহজ, তাৎক্ষণিক ও বহুমাত্রিক। কিন্তু তবুও, প্রশ্ন থেকেই যায়—হারিয়ে যাওয়া এই ল্যান্ডফোন সেবা কি আর কখনও ফিরে পাবে আগের গতি?

ল্যান্ডফোন ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে ল্যান্ডফোন ব্যবহার হয় মূলত অফিস, হাসপাতাল, সংবাদমাধ্যম, রেস্তোরাঁ কিংবা বিশেষ কিছু বাসাবাড়িতে—যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে চায় কর্তৃপক্ষ। যেমন ঢাকার হাতিরপুল, বাংলামোটর, কাঁঠালবাগান এলাকার বহু প্রতিষ্ঠান ও বাসায় এখনও টিএন্ডটি লাইন ব্যবহার হচ্ছে।

তবে ব্যবহারকারী কমে এলেও সেবার মান নিয়ে অভিযোগ বেড়েছে। গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, কদিন পরপরই লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আবার কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডায়াল টোন পাওয়া যায় না। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন নিয়মিত গ্রাহকরা।

সেবার ঘাটতি: লাইনের সমস্যাই মূল বাধা

ঢাকার পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম অনিক জানান, “আমাদের হটলাইনে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী কল দেন সিরিয়ালের জন্য। কিন্তু প্রায়ই লাইন থাকে অকেজো। ফলে রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে, সেবাও ব্যাহত হয়। সমস্যার কথা বিটিসিএলকে জানানো হলেও কিছুদিন পর আবার একই সমস্যায় পড়তে হয়।”

বাংলাভিশনের ব্রডকাস্ট অ্যান্ড আইটি বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার ইফতেখার হাসান অপু বলেন, “প্রতিদিন প্রোডাকশন টিম ও সংবাদদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ল্যান্ডলাইনের সংযোগ বিঘ্নিত হয়। এতে লাইভ সম্প্রচারে ঝুঁকি তৈরি হয়। প্রতিবার স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস পেলেও সেভাবে উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।”

বিটিসিএলের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি

ল্যান্ডফোন সেবার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) বারবার সংযোগ সমস্যার কথা স্বীকার করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নীলক্ষেত অঞ্চলের ম্যানেজার মোহাম্মদ ফয়েজ ছোটন বলেন, “গ্রাহকদের উন্নত সেবা দিতে আমরা এখন অপটিকাল ফাইবারের মাধ্যমে টেলিফোন এবং ইন্টারনেট সেবা একসঙ্গে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।”

তিনি আরও জানান, “সারাদেশে ‘র‌্যাপিড রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে, যারা যেকোনো সংযোগ সমস্যার দ্রুত সমাধান করবেন।” তবে ব্যবহারকারীরা মনে করছেন, কেবল পরিকল্পনার কথা নয়, বাস্তবায়নই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

কেন হারিয়ে যাচ্ছে ল্যান্ডফোন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা, নম্বর পোর্টেবিলিটি, দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ এবং কম খরচই ল্যান্ডফোনের জনপ্রিয়তা হারানোর মূল কারণ। এছাড়াও বিটিসিএল-এর দীর্ঘসূত্রতা, গ্রাহকসেবার ঘাটতি ও অনিয়মও বড় ভূমিকা রেখেছে।

এক সময় দেশে কোটি কোটি মানুষ টিএন্ডটির সংযোগ ব্যবহার করতেন। কিন্তু বিটিসিএলের নিজস্ব হিসাবেই এখন এই সংখ্যা মাত্র কয়েক লাখে নেমে এসেছে। ফলে আয়ের পরিমাণ কমেছে, সার্ভিসে বিনিয়োগ কমেছে, এবং সে অনুযায়ী উন্নয়নও থেমে গেছে।

আধুনিকায়নের সম্ভাবনা: ফিরে আসবে কি ল্যান্ডফোন?

বর্তমানে বিটিসিএল চেষ্টা করছে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে ‘আইপি-ভিত্তিক টেলিফোন সার্ভিস’ চালু করতে। এতে পুরনো এনালগ প্রযুক্তির জায়গায় আসবে ডিজিটাল কলিং সিস্টেম, যাতে থাকবে উন্নত মানের সাউন্ড, ডাটা ট্রান্সফার এবং দ্রুত সংযোগ সুবিধা।

বিশ্লেষকদের মতে, সঠিক বিনিয়োগ, কার্যকর ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ল্যান্ডফোন আবার নির্ভরযোগ্য ব্যাকআপ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফিরতে পারে। বিশেষ করে অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে।

সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সম্প্রতি সরকার বিটিসিএলকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট ও ল্যান্ডফোন সেবা দেওয়ার জন্য। এই উদ্যোগ সফল হলে শহর ও মফস্বলের বহু স্কুল-কলেজে আবারও ল্যান্ডফোনের চাহিদা বাড়তে পারে।

এছাড়া দুর্যোগকালীন সময়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেলে ল্যান্ডফোন হতে পারে নির্ভরযোগ্য বিকল্প। তাই টেকসই অবকাঠামো গড়তে পারলে ল্যান্ডফোনের প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি ফুরিয়ে যাবে না।

এক সময়ের রাজাধিরাজ ল্যান্ডফোন প্রযুক্তির আধুনিক ঝড়ের মুখে পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেও, এর প্রয়োজনীয়তা এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট। তবে বারবার সংযোগ বিচ্যুতি, গ্রাহকসেবার ঘাটতি ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা না কাটালে এই সেবা আগের গতি আর ফিরে পাবে না।

তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন পরিকল্পনার আলোকে বিটিসিএল যদি আন্তরিক হয়, তাহলে ল্যান্ডফোন আবারও ফিরতে পারে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে—যদিও সেই পথ হবে চ্যালেঞ্জে ভরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button