বিশ্ব

তিস্তার বন্যা ও ভূমিধসে সিকিমে বিপর্যয়, ৩ সেনা নিহত

ভারতের উত্তর সিকিম জেলায় তিস্তা নদীর উজানে টানা বৃষ্টি ও ভূমিধসের কারণে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রবিবার রাতে ছাতেন এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে ভূমিধসে ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনায় তিনজন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন এবং এখনও পর্যন্ত আরও ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে সামরিক সূত্রে জানা গেছে। আহত চার সেনা সদস্যকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নিহতদের পরিচয় ও সামরিক প্রতিক্রিয়া
সেনা সূত্রে জানানো হয়েছে, নিহত তিন সেনা সদস্য হলেন হাবিলদার লাখবিন্দর সিং, ল্যান্স নায়েক মুনিশ ঠাকুর এবং একজন পোর্টার অভিষেক লাখাড়া। তারা সবাই প্রবল বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ভূমিধসের কবলে পড়েন যখন পাহাড় ধসে পড়ে সেনা ক্যাম্পের ওপর। নিখোঁজ ছয়জনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) যৌথভাবে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। তবে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসের ঝুঁকি উদ্ধারকাজে বাধা সৃষ্টি করছে।

দুর্যোগের উৎস ও পরিস্থিতি
এই দুর্যোগের সূচনা ঘটে রবিবার সন্ধ্যায়, যখন মংগন জেলার লাচেন অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। আগের কয়েকদিন ধরেই সিকিম রাজ্যে অঝোর বৃষ্টি হচ্ছিল, যার ফলে তিস্তা নদীর পানি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যায়। মংগনে নদীর ওপর নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু পানির তোড়ে ভেঙে পড়ে, ফলে উত্তর সিকিম কার্যত মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পর্যটকদের দুরবস্থা
উত্তর সিকিমের লাচুং, লাচেন সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে আটকে পড়েছেন শত শত পর্যটক। পিটিআই সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ মে থেকে আটকে পড়া শতাধিক পর্যটককে সোমবার লাচুং থেকে উদ্ধার করে দজংগুর ফিডাং এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ৬৭৮ জনের আরেকটি পর্যটক দলকেও ধীরে ধীরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। এই পর্যটকরা অধিকাংশই দেশ-বিদেশ থেকে সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছিলেন।

অঞ্চলজুড়ে জারি সতর্কতা
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) উত্তর সিকিম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর জন্য লাল সতর্কতা জারি করেছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মেঘভাঙা বৃষ্টির সম্ভাবনা এখনো রয়েছে এবং তিস্তার জলস্তর এখনও বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। সেকারণে নদীতীরবর্তী ও ভূমিধসপ্রবণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উদ্ধার কাজে স্থানীয়দের সহায়তা
প্রশাসনের পাশাপাশি উদ্ধারকাজে সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন লাচুংপা সম্প্রদায়ের মানুষজন, যাদের অনেকেই স্থানীয় হোটেল মালিক। সোমবার সকালে আবহাওয়ার উন্নতির পরপরই এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা উদ্ধারকাজে হাত লাগান এবং পর্যটকদের ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করেন।

বিপর্যয়ের মাত্রা উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে
এই দুর্যোগ শুধু সিকিমেই সীমাবদ্ধ নয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্য—মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুরেও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে ভূমিধস ও বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এসব রাজ্যে অন্তত ১২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। বহু গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।

উত্তর সিকিমে চরম অবস্থা
সিকিমের সাত মাইলের মধ্যে নামচি জেলার লেগশিপ ও কিউজিংয়ের মধ্যেও ধস নেমেছে। এসব এলাকাতেও উদ্ধারকাজ চলছে। মংগন জেলা এখনো পুরোপুরি লাল সতর্কতার আওতায় রয়েছে। প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প পথ খুঁজে বের করে পর্যটকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। লাচুং হোটেল অ্যাসোসিয়েশন উদ্ধারকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল
বিগত বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সিকিম সফর নির্ধারিত থাকলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে তা বাতিল করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে সিকিম যাওয়ার কথা থাকলেও আবহাওয়ার অবস্থার অবনতির কারণে প্রশাসনের পরামর্শে সেই পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়।

বিপদে পর্যটক পরিবহন
এরই মধ্যে উত্তর সিকিমের চুংথাং থেকে মুন্সিথাং যাওয়ার পথে একটি পর্যটকবাহী গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং প্রায় ১২০০ ফুট নিচে তিস্তায় পড়ে যায়। গাড়িটিতে ১১ জন পর্যটক ছিলেন বলে জানা গেছে। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা যৌথভাবে কাজ করছে। ঘটনাস্থলের দুর্গমতা ও জলস্তরের উচ্চতা উদ্ধারকার্যে জটিলতা সৃষ্টি করছে।

জরুরি পদক্ষেপ ও সরকারী উদ্যোগ
সরকার ইতোমধ্যে তিস্তা নদীসংলগ্ন এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে ডিকচু, সিংথাম, চুংথাং ও মংগন এলাকার জনগণকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রশাসনের আশঙ্কা, পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে।

উপসংহার
তিস্তা নদীর জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ি ধস ও টানা বৃষ্টিপাত সিকিমকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এতে প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পর্যটননির্ভর এলাকার অর্থনীতিতেও বিপর্যয় নেমে এসেছে। সঠিক সময়ে আবহাওয়া স্বাভাবিক না হলে এবং দ্রুত পুনর্বাসন না ঘটলে এই সংকট আরও তীব্রতর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমেই এই বিপর্যয় মোকাবেলা সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button