প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিও লুবেতকিনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) ইতালির রোমে একটি হোটেলে এই সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত ও ফলপ্রসূ আলোচনা করেন তারা।
বিশেষ করে, ঢাকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্লক মারকোসুরভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এছাড়া তরুণদের বিনিয়োগে সম্পৃক্তকরণ এবং সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ সম্প্রসারণের কৌশল নিয়ে তারা বিশদভাবে মতবিনিময় করেন।
দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার
বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
বিশেষ করে, বাংলাদেশ এবং মারকোসুরভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করেন। বর্তমানে মারকোসুর (Mercosur) একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোট, যার সদস্য ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ে। এই অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা যথেষ্ট বিস্তৃত, যা ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ এবং পণ্য রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মারিও লুবেতকিন উভয়েই এ বিষয়ে একমত হন যে, অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন কেবল দুই দেশের মধ্যে নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
তরুণদের বিনিয়োগে সম্পৃক্তকরণ ও সামাজিক ব্যবসার প্রসার
বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পায় তরুণদের বিনিয়োগে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি। ড. ইউনূস তার বহুল আলোচিত “সামাজিক ব্যবসার” মডেল নিয়ে আলোচনা করেন, যার মাধ্যমে ব্যবসাকে কেবল মুনাফার জন্য নয়, বরং সামাজিক সমস্যার সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
মারিও লুবেতকিনও সম্মতি প্রকাশ করেন যে, তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব তৈরি এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে।
তারা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কৌশল এবং যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা করেন। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এবং উরুগুয়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়েও তারা চিন্তাভাবনা করেন।
থ্রি-জিরো অর্জনে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত
বৈঠকে থ্রি-জিরো (Zero Poverty, Zero Unemployment, Zero Net Carbon Emissions) অর্জনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন দুই নেতা।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে “থ্রি-জিরো ওয়ার্ল্ড” বাস্তবায়নের উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এই ধারণা অনুসরণ করে তারা সম্মত হন যে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনের জন্য উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করবে।
বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে পরিবেশ দূষণ, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে থ্রি-জিরো লক্ষ্য অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূস এবং মন্ত্রী লুবেতকিন এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন পথ খুঁজে বের করার উপর গুরুত্ব দেন।
উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন:
- লামিয়া মোর্শেদ — বাংলাদেশের এসডিজি সমন্বয়কারী
- তারেক আরিফুল ইসলাম — ভ্যাটিকানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
- রকিবুল হক — ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
তাদের উপস্থিতি এই আলোচনাকে আরও অর্থবহ করে তোলে এবং ভবিষ্যতে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের রূপরেখা তৈরিতে সহায়তা করে।
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার অংশগ্রহণ
প্রসঙ্গত, ওইদিনই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে ও পরে তিনি বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে এসব বৈঠক এবং আলোচনা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে সহায়তা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ-উরুগুয়ে সহযোগিতা আরও গভীর হলে, বাংলাদেশের জন্য ল্যাটিন আমেরিকায় নতুন রপ্তানি বাজার তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে পাটজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প এবং প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য এই অঞ্চলে বাংলাদেশের রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, উরুগুয়ের কৃষি ও মৎস্য খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার সুযোগ রয়েছে। উভয় দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসা ক্ষেত্রেও একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হতে পারে।