আঞ্চলিক

সারাদেশে বজ্রপাত ও ঝড়ে নিহত ১৩

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে বিরাজমান বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, হবিগঞ্জ, শেরপুর ও নওগাঁ জেলায় একজন করে মোট তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ সদরের মড়াকুড়ি গ্রামে গাছচাপায় দুই পথচারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

সারাদেশজুড়ে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত শুধু প্রাণহানিই ঘটায়নি, বরং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে। এতে ভেঙে পড়েছে গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, এবং ছিঁড়ে গেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে মানুষ। কৃষি খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, বিশেষ করে আমন ও গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষের ওপর।

হবিগঞ্জে গাছচাপায় প্রাণহানি

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎ শুরু হওয়া ঝড়ে একটি বড় আকারের ইউক্যালিপটাস গাছ ভেঙে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ৪৫ বছর বয়সী আব্দুল হামিদ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঝড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে তিনি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে গাছচাপা পড়ে প্রাণ হারান তিনি।

শেরপুরে বজ্রপাতে মৃত্যু

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় বুধবার সকাল ৯টার দিকে বজ্রপাতে মারা যান কৃষক রফিকুল ইসলাম (৫২)। তিনি মাঠে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে আক্রান্ত হন। স্থানীয় লোকজন তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নওগাঁয় প্রাণ হারান বৃদ্ধ

নওগাঁ সদর উপজেলার একটি গ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে ঝড়ের সময় বাড়ির উঠানে থাকা অবস্থায় ভেঙে পড়া একটি নারকেল গাছের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের। তার নাম আব্দুল কুদ্দুস বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন, যাদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ময়মনসিংহে গাছচাপায় দুই পথচারীর মৃত্যু

সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহে। সদরের মড়াকুড়ি গ্রামে কালবৈশাখী ঝড়ের সময় রাস্তার পাশের একটি পুরনো শিরীষ গাছ ভেঙে দুই পথচারীর ওপর পড়ে। তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। নিহতদের নাম মুহাম্মদ হানিফ (৩৮) ও রুবেল মিয়া (৩০)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ ঝড় শুরু হলে তারা আশ্রয়ের জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক তখনই গাছটি উপড়ে পড়ে তাদের গাড়িসহ চাপা দেয়।

সার্বিক ক্ষতির চিত্র

এছাড়াও ঝড়ের কারণে অনেক স্থানে বসতবাড়ি ও দোকানঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে টিনের ঘরগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। খোলা মাঠে থাকা গরু ও ছাগলের মৃত্যু হয়েছে কিছু কিছু স্থানে। কৃষকরা জানিয়েছেন, পাকা ধান এবং গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির ওপর এই ঝড়ের প্রভাব পড়েছে মারাত্মকভাবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মে মাসে একাধিক কালবৈশাখী ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতের সতর্কতা জারি করেছে।

প্রশাসনের তৎপরতা

স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে গাছচাপা পড়ে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. শরীফুল ইসলাম জানান, “ঘটনার পরপরই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মৃতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও দাফন-কাফনের ব্যয়ও প্রদান করা হচ্ছে।”

ঝড়ের পেছনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে এই ধরনের আকস্মিক ও তীব্র আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। অতীতে কালবৈশাখী ঝড় মূলত এপ্রিল-মে মাসে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। একই সঙ্গে ঝড়ের তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, “প্রতিবছরই দেখা যাচ্ছে, ঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব। আমাদের দুর্যোগ প্রস্তুতি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।”

জনসচেতনতা জরুরি

সরকারি সতর্কবার্তাগুলো যথাযথভাবে পালন এবং জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ঝড়ের সময় ঘরের বাইরে না যাওয়া, বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ ও গাছপালার নিচে না থাকা এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস মনোযোগ সহকারে অনুসরণ করার জন্য।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছানাউল হক জানান, “ঝড় ও বজ্রপাতের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আমরা প্রতিদিন পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। তা অনুসরণ করলে অনেক প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব।”

উপসংহার

কালবৈশাখী ঝড় বাংলাদেশে একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে সচেতনতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এবারের ঝড়ে প্রাণহানির পাশাপাশি কৃষি ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র দেখা গেছে, তা আরও বেশি প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে ঝুঁকি হ্রাস ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে—এটাই সময়ের দাবি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button