আঞ্চলিক

গঙ্গাচড়ায় আতঙ্ক কাটেনি, জিনিসপত্র নিয়ে গ্রাম ছাড়ছেন অনেকে

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বালাপাড়া হিন্দুপল্লীতে গত দুই দিন ধরে উত্তেজনার কারণে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের পরপরই গ্রামে সংঘটিত হামলা, ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারগুলোতে গভীর আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও ভয়ে অনেক পরিবার নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।

ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি: সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল অব্যাহত

সোমবার সকাল থেকে বালাপাড়া গ্রামে দেখা যায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের কঠোর টহল। তবে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও হিন্দু পরিবারের সদস্যদের ভেতরে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি স্পষ্ট। বাড়ির জিনিসপত্র ভ্যানে তুলে তারা কাছাকাছি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বা নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা হঠাৎ করেই মাইকিং করে লোকজন জড়ো করে বাড়িঘরে হামলা চালায়। এতে স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সা, গরু, আসবাবপত্রসহ বহু জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ থেকে উত্তেজনার সূত্রপাত

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠার পর শনিবার রাতে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে আটক করা হয়। পরদিন তার বিরুদ্ধে সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা দায়েরের পর আদালত তাকে শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠান। অভিযুক্ত কিশোরটি একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তার গ্রেপ্তারের পর উত্তেজিত জনতা বিক্ষোভে নামে এবং রাতেই বালাপাড়ার ওই কিশোরের বাড়ি ও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্তত ১৮টি বসতবাড়িতে হামলা চালানো হয়।

হামলার ধরণ: বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের অভিযোগ, শনিবার রাতের ঘটনার পর রবিবারও পরিস্থিতি থেমে থাকেনি। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাংলাবাজার এবং খিলালগঞ্জ এলাকা থেকে লোকজন মাইকিং করে গ্রামে এসে আরও হামলা চালায়। শুধু ভাঙচুর নয়, তারা অনেকের বাড়ি থেকে গরু, ফ্রিজ, টিভি, চাল, কাপড়-চোপড়, নগদ টাকা এবং স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে গেছে।

প্রমোদ মোহন্ত, সুজন রায়, জয়চাঁদ রায়, রবীন্দ্রনাথ রায়সহ অন্তত ১৮টি পরিবারের বসতবাড়ি আক্রমণের শিকার হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় নারী ও শিশুদের মধ্যেও ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছেন অনেক পরিবার

স্থানীয় ইউপি সদস্য পরেশ চন্দ্র রায় জানান, সোমবার দুপুর পর্যন্ত অন্তত ২৫টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। যারা এখনও গ্রামে আছেন, তাদের অনেকেই বাইরে বের হচ্ছেন না। আক্রান্ত পরিবারগুলোর অনেকেই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও হামলা ঠেকানো যায়নি, তাই তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

অধীর চন্দ্র রায় নামের এক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বলেন, “ঘরে খাবার নেই, চুলো নেই। হামলাকারীরা গরু নিয়ে গেছে। হাতে টাকা-পয়সা নেই। পরিবার নিয়ে এখন থাকার উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়তে হচ্ছে।”

পলাশ চন্দ্র রায়ও বলেন, “ভয়ে পরিবারকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। এখানে থাকলে আবার কখন হামলা হয়, কে জানে!”

প্রশাসনের বক্তব্য: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দাবি

গঙ্গাচড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল এমরান বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কিছু পরিবার আতঙ্কে গ্রাম ছেড়েছে, তবে আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করেছি। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন, “ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত কিশোরের পরিবারসহ কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের শুকনো খাবার দিচ্ছি এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। গ্রামবাসীদের অনুরোধ করছি, আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে থাকার জন্য।”

গ্রামবাসীর শঙ্কা: পুনরায় হামলার ভয়

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বলছেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এবারও হামলা ঠেকাতে না পারে, তাহলে আবারও হামলা হতে পারে। তাই আপাতত গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ

সাময়িকভাবে সেনা ও পুলিশ মোতায়েন থাকলেও গ্রামের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন রয়ে গেছে, বাহিনী চলে গেলে কী হবে? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আশা করছে, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ ও স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, যাতে তারা পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।

এম আর এম – ০৫৭২, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button