এসএমইদের মূলধারায় আনার উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) আর্থিক ব্যবস্থার মূলধারায় আনতে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণ কেন বাড়ছে না, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যালোচনা করছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বুধবার অনুষ্ঠিত ‘নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণমান নির্ধারণ ও ক্ষুদ্রঋণ’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন গভর্নর। কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে এসএমই ফাউন্ডেশন ও এশিয়া ফাউন্ডেশন।
এসএমই খাতের অগ্রগতি নিয়ে গভর্নরের বক্তব্য
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশে তথ্য মূল্যায়নের প্রচলন খুবই কম, যার কারণে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে বিষয়ে পরিকল্পনা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এর পেছনে সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাগত কারণগুলো প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে।
নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ অন্তত ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলক করা হোক। এটি করা গেলে ব্যাংকিং সুবিধাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।’
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণমান নির্ধারণের গুরুত্ব
কর্মশালায় আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশের এসএমই উদ্যোক্তারা জামানতবিহীন ঋণ পেতে নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং শর্ত পূরণ করতে না পারার কারণে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. নাজিম হোসেন সাত্তার জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসএমই ফাউন্ডেশন দেশের প্রায় ১০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার মধ্যে সহজ শর্তে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এতে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ছিল ২৫ শতাংশ।
তিনি আরও বলেন, ‘ঋণপ্রদানের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত, গ্যারান্টি ও আর্থিক রেকর্ডের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কাছে এসব নথিপত্র না থাকায় তারা ঋণ থেকে বঞ্চিত হন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণমান নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করা গেলে উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রাপ্তি সহজ হবে।’
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ সহায়তা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, ‘নারীদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণ প্রদান পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজ হবে।’
প্যানেল আলোচকদের মতামত
কর্মশালায় উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা এআই-ভিত্তিক ঋণমান নির্ধারণ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা, তথ্যের নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল মোমেন বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং কাঠামোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিশেষ নীতি প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক নওশাদ মোস্তফা বলেন, ‘প্রযুক্তি নির্ভর ঋণ ব্যবস্থা চালু করা হলে উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং অর্থনীতির মূলধারায় এসএমইদের অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন কিছু নীতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে নিজেদের ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভর ঋণ প্রদান পদ্ধতি চালু করা হলে এসএমই খাত আরও শক্তিশালী হবে।’
এছাড়া, প্রযুক্তি-নির্ভর ঋণ প্রদান ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুততম সময়ে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় বলে জানান তিনি।
উপসংহার
কর্মশালায় বক্তারা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ঋণমান নির্ধারণ পদ্ধতি বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ পদ্ধতির মাধ্যমে তারা সহজেই ঋণ সুবিধা পেতে পারেন।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং কাঠামো গড়ে তুললে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বেগবান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।