আঞ্চলিক

টেলিগ্রাম অ্যাপে ফাঁদ পেতে টাকা হাতিয়ে নেয়া দুই যুবক গ্রেপ্তার

রংপুরে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ভুয়া অনলাইন কোম্পানির নামে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আটককৃতরা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার তাজপুর ও বানারশিপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসহ একাধিক ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে।

কিভাবে প্রতারণা করত চক্রটি?

গ্রেপ্তার হওয়া যুবকদের নাম আজাদ মিয়া (২৪) এবং মারুফ আহমদ পারভেজ (২১)। তারা দীর্ঘদিন ধরে টেলিগ্রাম অ্যাপে ভুয়া অনলাইন বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলত। ‘FindPenguinTour.com’ নামের একটি ভুয়া কোম্পানির নামে তারা বিনিয়োগ করলে উচ্চ কমিশন দেওয়া হবে বলে প্রলোভন দেখাত।

চক্রটি প্রথমে ভিকটিমের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিভিন্ন স্ক্রিনশট, ভুয়া সার্টিফিকেট ও লভ্যাংশের হিসাব দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করত। এরপর ধাপে ধাপে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। টাকা পাওয়ার পর তারা মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে কিংবা অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে গা ঢাকা দিত।

প্রতারণার শিকার: অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যের ছেলে

এই প্রতারণার শিকার হন পীরগঞ্জ উপজেলার কেশবপুর এলাকার নাহিদ হাসান বাপ্পী। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মো. লাবলু মন্ডলের ছেলে। চলতি বছরের ২১ এপ্রিল নাহিদ ‘FindPenguinTour.com’ নামের টেলিগ্রাম চ্যানেল থেকে বিনিয়োগের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে প্রথমে নগদ এবং ডাচবাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে মোট ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৬৭ টাকা পাঠান।

এরপর প্রতারকরা তাকে জানায়, তাকে ১৬ লাখ টাকা লভ্যাংশসহ ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আবারও ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দাবি করে এবং হুমকি দেয়—এই টাকা না দিলে কোনও লভ্যাংশ দেওয়া হবে না।

মামলা ও গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া

নাহিদের বাবা লাবলু মন্ডল বিষয়টি বুঝতে পেরে গত ১৪ মে পীরগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। মামলার তদন্তে নেমে পীরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসান তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রতারকদের অবস্থান শনাক্ত করেন।

পরবর্তীতে ১৮ জুলাই পুলিশ সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক চক্রের দুই সদস্য আজাদ ও মারুফকে গ্রেপ্তার করে। একই দিন দুপুরে আদালতের মাধ্যমে তাদের রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

চক্রটি কাদের নিয়ে গঠিত এবং তাদের পরিকল্পনা কী?

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার দুইজন একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। এ চক্রের আরও সদস্য রয়েছে যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে একইভাবে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। তাদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ উদ্যোক্তা, চাকরি খোঁজারত যুবক এবং প্রবাসীদের পরিবার।

তারা এমন সব গ্রুপ ও অ্যাপ বেছে নেয় যেগুলোর নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ তুলনামূলক কম। টেলিগ্রাম এমন একটি অ্যাপ যেখানে পরিচয় গোপন রাখা সহজ হওয়ায় এটি প্রতারকদের অন্যতম পছন্দের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

পুলিশের সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

পীরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, “দেশে অনলাইন অ্যাপস ও প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনেকেই মোটা অঙ্কের কমিশনের লোভে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। আমরা ইতিমধ্যে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি এবং দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

তিনি আরও জানান, “প্রতারকদের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ও ডিভাইসগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে চক্রের বাকি সদস্যদের নাম ও প্রতারণার আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে।”

অনলাইন প্রতারণা: সচেতন না হলে কেউই নিরাপদ নয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র টেলিগ্রাম নয়, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য মেসেজিং অ্যাপেও প্রতারণার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অধিকাংশ প্রতারক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে এবং পরে ধাপে ধাপে টাকা হাতিয়ে নেয়।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “কোনও অনলাইন অফার বা বিনিয়োগ প্রস্তাব পেলে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। সরকার অনুমোদিত না হলে এমন প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।”

অনলাইন প্রতারণা ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতা জরুরি

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি এর অপব্যবহার করে কিছু অপরাধী প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। তাই সচেতনতা, আইন প্রয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে এই ধরনের প্রতারণা প্রতিরোধ করা এখন সময়ের দাবি।

তবে প্রশ্ন থেকে যায় — প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, ব্যবহারকারীরা যদি সচেতন না হন, তাহলে প্রতারকদের থামানো আদৌ কি সম্ভব?

এম আর এম – ০৪৩৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button