স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করলো সরকার

বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সুতা আমদানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দেশের বৃহত্তর অর্থনীতিতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা এবং বুড়িমারী — এই পাঁচটি প্রধান স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানির অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে এই নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
মূলত গত ১৫ এপ্রিল থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সুতার আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে বেনাপোলসহ দেশের অন্যান্য প্রধান স্থলবন্দরগুলোতে সুতার ট্রাক প্রবেশ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। যদিও অন্যান্য পণ্যের আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
দেশের বস্ত্রখাতের স্বার্থেই আমদানি সীমিত
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) দীর্ঘদিন ধরেই স্থলপথে ভারতীয় সুতা আমদানির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। কারণ, ভারতীয় সুতা মূলত উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মিল থেকে উৎপাদিত হয়ে কলকাতার গুদামে সংরক্ষিত হয়। পরে সেখানে থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই কম দামের কারণে দেশের পোশাকশিল্প উদ্যোক্তারা ভারতীয় সুতা ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এর ফলে দেশীয় টেক্সটাইল মিলগুলো প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং উৎপাদন কার্যক্রম সংকুচিত হচ্ছিল।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল সুতা হলেও, ট্যারিফ কমিশন এক চিঠির মাধ্যমে এনবিআর-কে স্থলপথে সুতার আমদানির সীমাবদ্ধতা আরোপের অনুরোধ জানায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, দেশের সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সুতা কাউন্ট পরিমাপের জন্য যথাযথ অবকাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই দেশীয় সুতার স্বার্থ রক্ষায় স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির পথ বন্ধ রেখে সমুদ্রপথে আমদানির প্রক্রিয়া বজায় রাখার সুপারিশ করা হয়।
টেক্সটাইল খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ
বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল যে, স্থলপথ দিয়ে কম দামে ভারতীয় সুতা প্রবেশের কারণে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎপাদন ও বাজারপ্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই সংস্থাটি এ বিষয়ে সরকারের কাছে সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি জানায়। তাদের দাবি ছিল, অবাধে সুতা আমদানির সুযোগের ফলে স্থানীয় মিলগুলো অর্ডার হারাচ্ছে এবং শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংকটে পড়ছে।
বিটিএমএ-র বক্তব্য মতে, স্থলপথ দিয়ে প্রবেশ করা ভারতীয় সুতার কোনো মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা না হওয়ায় বাজারে সুলভ দামে এসব সুতা ছড়িয়ে পড়ছে। এতে স্থানীয় কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমদানি নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সরকারের যুক্তি ও নীতিগত অবস্থান
এই প্রেক্ষাপটে সরকার জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্থলবন্দর থেকে সুতার আমদানির সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দেশের সুতা উৎপাদক মিলগুলো কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। যদিও আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের মতে, এতে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ উভয়ই বেড়ে যাবে, বিশেষ করে সমুদ্রপথে সুতার আমদানির ক্ষেত্রে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে ট্যারিফ কমিশনের পরামর্শকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, স্থলপথ দিয়ে দ্রুত ও সহজে কম খরচে সুতা আমদানি হওয়ায় দেশের উৎপাদক মিলগুলো প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে এবং অনেক সময় লোকসানের মধ্যে চলে যায়। তাই এই সিদ্ধান্ত শিল্প রক্ষার প্রয়াস হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
তবে এনবিআর স্পষ্ট করেছে, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ হলেও সমুদ্রপথ বা অন্য কোনো পথ ব্যবহার করে আমদানি চালু থাকবে। এতে করে যারা আন্তর্জাতিক মানের সুতা প্রয়োজন মনে করেন, তারা সমুদ্রপথের মাধ্যমে তা আমদানি করতে পারবেন।
বেনাপোল বন্দর ও আমদানিকারকদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোল, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০-৫০০ ট্রাক ভারতীয় পণ্য প্রবেশ করে। এর মধ্যে গার্মেন্টস খাতের জন্য ৬০-৭০ ট্রাক সুতা আসত নিয়মিত। নতুন এই নির্দেশনার পর সেই আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীরা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছেন।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্য পণ্য আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক থাকলেও সুতার ট্রাক এখন আসছে না। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সমুদ্রপথে আমদানি করলে খরচ কিছুটা বাড়লেও মান নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে এটা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। এতে দেশীয় উৎপাদকরা ন্যায্য প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে।
টেক্সটাইল খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের টেক্সটাইল শিল্প যদি সুতা উৎপাদনে পর্যাপ্ত সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত শিল্পের জন্য আশীর্বাদে পরিণত হবে। দেশীয় সুতা ব্যবহার বাড়লে দেশের অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। একই সঙ্গে স্থানীয় কর্মসংস্থান বাড়বে এবং শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে এই সিদ্ধান্ত দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এটি বাস্তবায়নের পাশাপাশি সুতা কাউন্ট নির্ণয়ের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসম্পন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্ত দেশের গার্মেন্টস খাতের কাঁচামাল সংকট তৈরি করতে পারে।
উপসংহার
স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশের অর্থনীতিতে একদিকে যেমন স্বল্পমেয়াদি কিছু অসুবিধা তৈরি করবে, অন্যদিকে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের জন্য তা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করবে বলেই আশাবাদী শিল্প সংশ্লিষ্টরা। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার দেশীয় শিল্পকে রক্ষার সুস্পষ্ট বার্তা দিল। তবে এর বাস্তবায়নে কঠোর মনিটরিং এবং দ্রুত মাননিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি, যেন দেশীয় শিল্প কাঠামো আরও শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।