ভিয়েতনাম থেকে এলো সাড়ে ১২ হাজার টন চাল

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার এবং সরকারি মজুত বৃদ্ধির লক্ষ্য সামনে রেখে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা আরও সাড়ে ১২ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন খাদ্য অধিদফতরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) এই চাল আমদানি কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ পরিমাণ চালের এই চালানটি দেশের বন্দরে সঠিকভাবে পৌঁছেছে এবং ইতোমধ্যে জাহাজে রক্ষিত চালের নমুনা পরীক্ষার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এখন খুব শিগগিরই চাল খালাসের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, দেশের খাদ্যশস্য মজুতের ভারসাম্য রক্ষায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার ভিয়েতনামের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে মোট ১ লাখ টন আতপ চাল আমদানির একটি সমঝোতা চুক্তি করে। এই চুক্তির আওতায় ইতোমধ্যে ৭২ হাজার ৭০০ টন আতপ চাল দেশে পৌঁছেছে। বাকি চালের চালান পর্যায়ক্রমে দেশে আসছে, যার অংশ হিসেবেই সদ্য আগত এই সাড়ে ১২ হাজার টন চাল।
খাদ্য নিরাপত্তায় আমদানির গুরুত্ব বাড়ছে
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের খাদ্য মজুতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং দুর্যোগকালীন সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি পর্যায়ে এই চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বছরের খরা ও বন্যা পরিস্থিতির প্রভাবে দেশের ধান উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ায় সরকার কৌশলগতভাবে বিদেশ থেকে চাল আমদানির পথে হেঁটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় এবং ভিয়েতনাম থেকে সরকারিভাবে স্বল্পমূল্যে আমদানির সুযোগ থাকায় বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের খাদ্য সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দামও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।
জিটুজি পদ্ধতির মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত
বর্তমানে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ আমদানির এ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হচ্ছে জিটুজি (Government-to-Government) ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই পদ্ধতি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করে থাকে। সরকার-পর্যায়ের এই চুক্তির মাধ্যমে সরাসরি চাল আমদানি করা হয়, ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা থাকে না। এতে করে চালের দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “বর্তমানে দেশে চালের সরবরাহ ও মজুত পরিস্থিতি আশানুরূপ রয়েছে। আমদানিকৃত চাল দ্রুত খালাস শেষে দেশের বিভিন্ন গুদামে সরবরাহের কার্যক্রম শুরু হবে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায্য দামে বাজারে চালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত রাখা।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের ইতিবাচক ইঙ্গিত
ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম বাণিজ্যিক সম্পর্কের আরেকটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ধরনের সরকারি পর্যায়ের চুক্তি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও সুসংহত করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. নুরুল আমিন বলেন, “বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের proactive নীতিমালা আজ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও কৌশলগত বন্ধন গড়ে তুলছে। ভিয়েতনাম থেকে আমদানিকৃত এই চাল শুধু মজুত নয়, বরং দেশের মূল্যস্ফীতির চাপে ভোক্তাদের উপর যে চাপ পড়ে তা হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
চাল খালাস ও বিতরণ পরিকল্পনা
চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর চাল খালাস ও বিতরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সম্পাদন করা হবে বলে জানিয়েছে খাদ্য অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই চাল প্রথম ধাপে সরকারের বিভিন্ন গুদামে সরবরাহ করা হবে। এরপরে প্রয়োজন অনুযায়ী ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল), টিসিবি এবং রেশনিং কর্মসূচির আওতায় সাধারণ জনগণের মাঝে সরবরাহ শুরু হবে।
এছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ের গুদামগুলোতে চাল সরবরাহ সম্পন্ন করার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ভর্তুকি মূল্যে কম আয়ের মানুষের খাদ্য সহায়তায় এই চাল ব্যবহার করা হবে। খাদ্য অধিদফতর বলছে, “সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আনাই মূল লক্ষ্য।”
কৃষকদের স্বার্থ ও আমদানির ভারসাম্য
অবশ্য, দেশের কৃষি উৎপাদন এবং কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় সরকার আমদানিতে যথাযথ ভারসাম্য বজায় রাখছে বলেও জানা গেছে। খাদ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আমদানির মাধ্যমে শুধু সরকারি মজুত পূরণের পরিকল্পনা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে কৃষকদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত রাখতে আমদানির সময়সীমা এবং পরিমাণ সুপরিকল্পিতভাবে নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদনের মধ্যে এই সমন্বয় বজায় রাখায় কৃষি খাত এবং বাজার ব্যবস্থাপনা উভয়ই স্থিতিশীল থাকবে।
সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা নীতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের মজুত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি গুদামে কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল সংরক্ষণের লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেশীয় সংগ্রহের পাশাপাশি বৈদেশিক উৎস থেকে আমদানির ওপরও নির্ভর করতে হচ্ছে।
ভিয়েতনাম থেকে এ পর্যন্ত আসা চালের এই চালান দেশে খাদ্য মজুত লক্ষ্য পূরণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সরকার। পর্যায়ক্রমে আরও চালান দেশে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা থাকলেও সরকার জনগণের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই আমদানি সহায়ক ভূমিকা রাখবে।”
উপসংহার:
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে ভিয়েতনাম থেকে আমদানিকৃত এই সাড়ে ১২ হাজার টন চাল দেশের মজুত ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। সরকারের জিটুজি চুক্তির আওতায় এমন উদ্যোগ অভ্যন্তরীণ বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে এবং দুর্যোগকালীন খাদ্য সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।