গরমে আইসক্রিমের বিক্রি হু হু করে বাড়ছে, কয়েক বছরে তিনগুণ বড় হয়েছে বাজার

দেশজুড়ে প্রখর গ্রীষ্মের তাপে হাঁসফাঁস অবস্থা মানুষের। এই তাপপ্রবাহে যেমন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ঠান্ডা খাবার ও পানীয়র চাহিদা। বিশেষ করে আইসক্রিমের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। গরম যত বাড়ছে, ততই যেন রেকর্ড পরিমাণে বাড়ছে আইসক্রিমের বিক্রি। ব্যবসায়ীদের ভাষায়, বছরের এই সময়টা আইসক্রিম খাতের জন্য ‘সোনালী মৌসুম’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত এক দশকে আইসক্রিমের বাজার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বাজারের পরিসর দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি, যা চলতি বছর শেষে পৌঁছাতে পারে ৩ হাজার কোটি টাকায়। এ খাত প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে বলেও জানা গেছে।
গ্রীষ্মেই বিক্রির ৮০ শতাংশ
আইসক্রিম ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুসারে, মার্চ থেকে আগস্ট—এই ছয় মাসেই হয় বার্ষিক বিক্রির প্রায় ৮০ শতাংশ। আব্দুল মোনেম গ্রুপের ‘ইগলু’ ও ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের ‘পোলার’—এই দুই ব্র্যান্ড মিলে বাজারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। বাকি অংশে রয়েছে সেভয়, লাভেলো, বেলিসিমো, জা-এন-জি, ব্লুপ, কোয়ালিটি ও আঞ্চলিক ব্র্যান্ডগুলো—যেমন চট্টগ্রামের পান্ডা, মাগুরার পিপাসা ও খুলনার মিল্কিস।
কাঁচামালে কর আর সংরক্ষণের সমস্যা
আইসক্রিম তৈরির কিছু মৌলিক উপাদান যেমন চিনি, পানি ও বাটার দেশেই পাওয়া গেলেও চকলেট, মিল্ক ফ্যাট, ফুল ক্রিম মিল্ক ও ফ্লেবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল আমদানি করতে হয় ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে। এসব উপাদানে রয়েছে ৩৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক, যা ব্যবসা সম্প্রসারণের অন্যতম বড় বাধা।
ইগলুর জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক নাসিরুজ্জামান বলেন, প্রতিদিন তারা দেড় লাখ লিটারের বেশি আইসক্রিম উৎপাদন করছেন। তবে কাঁচামালের উচ্চ কর ও পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার অভাবে এ খাতের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না।
বিক্রিতে নতুন রেকর্ড, পারলারগুলোয় উপচে পড়া ভিড়
রাজধানীর ধানমন্ডি, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন বাড়ছে আইসক্রিম পারলার ও কিয়স্কের সংখ্যা। সুইস ব্র্যান্ড মুভেনপিক–এর ধানমন্ডি শাখার ম্যানেজার মুরাদ রাজ বলেন, গরমে তাদের দৈনিক বিক্রি এখন এক লাখ টাকার ওপরে, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ।
বেলিসিমো, সেভয় গ্যালারি–সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বলছে, এ বছর তাদের বিক্রি ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সেভয় গ্যালারির ব্যবস্থাপক সুমন হোসেন জানান, আগে যেখানে দিনে ১০-১২ টাব (প্রতিটি ৫ লিটার) বিক্রি হতো, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৮-২০ টাব।
পাড়া-মহল্লার দোকানেও বিক্রি দ্বিগুণ
শুধু বড় পারলার নয়, পাড়ার মুদিদোকানেও আইসক্রিম বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। মোহাম্মদপুরের দোকানি শিমুল বড়ুয়া বলেন, “আগে দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হত, এখন তা পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত যাচ্ছে।”
দ্রুত বাড়ছে ব্র্যান্ডের দখল
গোল্ডেন হারভেস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে দেশের আইসক্রিম বাজারের আকার ছিল ৭৩০ কোটি টাকা। এক বছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বাজারের আকার পৌঁছায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়—যা চার বছরে প্রায় তিনগুণ প্রবৃদ্ধি।
বাজার গবেষণা অনুযায়ী:
- পোলার: ৩১.৫১% শেয়ার নিয়ে শীর্ষে
- ইগলু: ২৭% নিয়ে দ্বিতীয়
- সেভয়: ১৩.৪৫% নিয়ে তৃতীয়
- লাভেলো: ১১.৭২% নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে
ঢাকার বাইরেও বাজার বড় হচ্ছে
লাভেলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল হক বলেন, “আগে ঢাকার বাইরে এতটা বিক্রি হতো না, কিন্তু এখন বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কোন ও কাপে প্যাকেটজাত আইসক্রিম।”
তরুণরা প্রধান ক্রেতা
এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের আইসক্রিম ভোক্তাদের অর্ধেকই শিশু থেকে ৩০ বছরের তরুণ-তরুণী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবয়সীদের মধ্যেও আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
ভারতের বাজার থেকে অনুপ্রেরণা
ভারতীয় আইসক্রিম প্রস্তুতকারক সংস্থা (IICMA) জানিয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে ভারতের আইসক্রিম বাজার ৪৫ হাজার কোটি রুপিতে পৌঁছাতে পারে। একই ধারা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশেও আগামী পাঁচ বছরে এই খাত অন্যতম বৃহৎ খাদ্যশিল্পে রূপ নিতে পারে।
প্রচণ্ড গরম ও ক্রমবর্ধমান আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে দেশের আইসক্রিম বাজার। ব্যবসার এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন নীতিগত সহায়তা, করছাড় ও আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা। তাহলেই ভবিষ্যতে এই খাত হতে পারে দেশের অন্যতম লাভজনক ফুড সেক্টর।