আঞ্চলিক

জুলাই সনদ তৈরি করাই সরকারের মূল লক্ষ্য: প্রধান উপদেষ্টা

জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল এজেন্ডা হিসেবে জুলাই সনদ তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, এই সনদই হবে সামনের দিনগুলোর রাজনৈতিক পথনকশা। সোমবার (২ জুন) বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্যায়ের সর্বদলীয় বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে দেশের ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর কার্যক্রমে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা।

ঐকমত্য ভিত্তিক সনদই আগামী দিনের নির্দেশনা

বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “জুলাই সনদ তৈরিই অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য লক্ষ্য। এই সনদের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে প্রথম পর্যায়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে। এরপর তা গণভবনের বাইরে দেশের জনগণের সামনে উন্মুক্ত করা হবে।”

তিনি আরও বলেন, “রাজনীতি কোনো বিভক্তির মাধ্যম নয়। রাজনীতি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, দেশের সমৃদ্ধির জন্য। এখন সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক অনন্য সুযোগ এসেছে। আমরা যেন এই সুযোগ হারিয়ে না ফেলি।” এসময় তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আপনাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, কারণ এখানে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা হচ্ছে। এই কাজে যুক্ত থাকতে পারা আমার জন্য গর্বের।”

দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা এবং ধৈর্যের প্রশংসা

প্রধান উপদেষ্টা কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরে বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। এজন্য আমরা তাদের তিন মাস সময় দিয়েছিলাম। অধিকাংশ কমিশন নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ করেছে। কয়েকটি কমিশন অতিরিক্ত সময় নিয়েছে, তবে তা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই।”

তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও ধৈর্যশীলতাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, “আপনারা সকলে যে মনোযোগ ও সম্মান নিয়ে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই মানসিকতা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।”

দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু মঙ্গলবার

বৈঠক চলাকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার (৩ জুন) থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে দ্বিতীয় দফায় সংলাপ শুরু হবে। এই পর্যায়ে দলগুলো তাদের প্রস্তাবনা ও আপত্তিগুলো সরাসরি তুলে ধরার সুযোগ পাবে। প্রত্যেক দলের জন্য নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

প্রেস সচিব আরও বলেন, “প্রথম পর্যায়ে সম্মিলিত আলোচনায় যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে, দ্বিতীয় দফার আলাদা বৈঠকে সেগুলো আরও সুস্পষ্ট করে সংলাপ হবে। একইসাথে এখনো যেসব বিষয়ে মতানৈক্য রয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে সমাধান খোঁজা হবে।”

বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাদের উপস্থিতি ও ভূমিকা

দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে শুরু করেন। প্রথমে উপস্থিত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। এরপর একে একে অন্যান্য দলগুলোর নেতারাও বৈঠকে অংশ নেন।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এলডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ন্যাপ-ভাসানী, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন দল বৈঠকে অংশগ্রহণ করে।

একাধিক ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারাও জানান, এতদূর পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা গ্রহণযোগ্য। তবে জুলাই সনদে যদি বাস্তবসম্মত ও অংশগ্রহণমূলক রোডম্যাপ থাকে, তাহলেই তা কার্যকর হবে। নচেত এটাও অতীতের মতো এক প্রক্রিয়া হয়েই থেকে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বৈঠকের গুরুত্ব

বৈঠক শেষে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনার পরিসর তৈরি করছে, তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক। তারা বলেন, “এই প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করছে সরকার কতটা আন্তরিকভাবে আলোচনার ফলাফল বাস্তবায়নে কাজ করবে তার উপর।”

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেন, “এই সংলাপ এবং পরবর্তী জুলাই সনদ কেবল নির্বাচনের পূর্বশর্ত নয়, বরং এটি হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সামাজিক চুক্তি। আমরা চাই সবাই যেন এতে তাদের প্রতিনিধিত্ব দেখতে পায়।”

এ পর্যায়ে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে আরেকবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান, “গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে আলোচনার টেবিলে আমাদের উপস্থিত থাকতে হবে। আপনারা আজ যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, সেটিই আগামী দিনগুলোতে দেশকে এগিয়ে নেবে।”

উপসংহার

সর্বদলীয় বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক সাড়া এবং সরকারপ্রধানের উদ্দীপনামূলক বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আশার আলো জাগিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফার সংলাপে দলগুলো কতটা খোলামেলা আলোচনা করতে পারে এবং সেই আলোচনা কতটা বাস্তবসম্মতভাবে জুলাই সনদে প্রতিফলিত হয়।

এই মুহূর্তে জাতির দৃষ্টি তাকিয়ে আছে সেই জুলাই সনদের দিকে, যা হতে পারে একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা—যেখানে একত্রিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং দেশের ভবিষ্যৎ পথচলা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button