সম্পত্তি বিক্রি করে টিএনজেডের শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হবে: শ্রম উপদেষ্টা

টিএনজেড লিমিটেড ও মাহমুদ গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও প্রাপ্য পরিশোধের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান দুটির জমি, বাড়ি, কারখানা এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
সভায় জানানো হয়, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে সরকারের অবস্থান দৃঢ় এবং কোনোভাবেই শ্রমিকদের পাওনা অবহেলিত হবে না। এই উদ্যোগকে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কঠোর নির্দেশনা মালিকদের প্রতি
শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘টিএনজেড ও মাহমুদ গ্রুপের মালিকদের আজ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে—তাঁরা যেন শ্রমিকদের বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করেন। অন্যথায় তাঁদের সব ধরনের স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু টিএনজেড বা মাহমুদ গ্রুপের জন্য নয়, বরং সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই প্রযোজ্য যারা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রম উপদেষ্টা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘শ্রমিকদের পাওনা কোনোভাবেই মাফ করা হবে না। আইন অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের দায়বদ্ধতা পালন করতেই হবে।’
অন্য কারখানাগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা
উপদেষ্টা আরও জানান, টিএনজেড ও মাহমুদ গ্রুপ ছাড়াও যেসব কারখানা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে গড়িমসি করছে, তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনে সেই সব মালিকদের সম্পত্তিও বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
তিনি বলেন, ‘এখন থেকে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বঞ্চিত করলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট
টিএনজেড ও মাহমুদ গ্রুপের মালিকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলেও জানান উপদেষ্টা। একইসঙ্গে ডার্ড গ্রুপ, জেনারেশন নেক্সট এবং রোয়ারর ফ্যাশনের মালিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কোনোভাবেই বিদেশে অবস্থান করে দায় এড়াতে পারবেন না।
সরকারি উচ্চপর্যায়ের সমন্বয় সভা
উক্ত বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিকেএমইএর সভাপতি, বিজিএমইএ প্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সরকারি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে এবং শ্রম আইন বাস্তবায়নে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সভায় শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোর আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শ্রমিকদের স্বস্তি, ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব
টিএনজেড ও মাহমুদ গ্রুপের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক মাসের পর মাস বেতন ও প্রাপ্য না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। সরকারের এই হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এসেছে। অনেক শ্রমিক বলেন, এতদিন আমরা শুধু আশ্বাস পেতাম। এবার মনে হচ্ছে, সরকার সত্যিই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রতিনিধিরাও জানান, তারা শ্রমিকদের বকেয়া সমস্যা সমাধানে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে মালিকদের উচিত নিজেদের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করা, যাতে এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আর সৃষ্টি না হয়।
পর্যালোচনা ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ দেশের শ্রমিকদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতারই প্রতিফলন। তারা মনে করেন, শিল্পখাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এই ধরনের কঠোর পদক্ষেপ একান্ত জরুরি। এটি অন্য মালিকদের জন্যও একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে।
সমাপ্তি
সরকারের এই উদ্যোগ শুধু শ্রমিকদের পাওনা আদায় নয়, বরং সামগ্রিকভাবে শিল্প খাতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছেন, যত দ্রুত সম্ভব এই বকেয়া সমস্যার নিষ্পত্তি হবে এবং শ্রমিকদের প্রাপ্য তাদের হাতে পৌঁছে যাবে।
শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা এবং শিল্পখাতের টেকসই উন্নয়নে সরকারের এই ভূমিকা প্রশংসনীয়। আগামী দিনগুলোতে আরও জবাবদিহিমূলক এবং মানবিক শিল্প-পরিবেশ গড়ে তুলতে এ ধরনের উদ্যোগ জারি থাকবে বলেই প্রত্যাশা।