ন্যাটো সম্প্রসারণ না হলে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে রাজি পুতিন

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ইঙ্গিত দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে এর জন্য তিনি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রেখেছেন কড়া কিছু শর্ত। তার অন্যতম হলো, ন্যাটোর আর কোনো সম্প্রসারণ নয়—বিশেষ করে ইউক্রেন, জর্জিয়া ও মলদোভাকে সামরিক জোটটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর বরাতে এমনটাই জানা গেছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ তিনটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, এখন পুতিন একটি লিখিত চুক্তি চাচ্ছেন যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব স্পষ্টভাবে ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার প্রতিশ্রুতি দেবে। যদি এই শর্ত পূরণ করা হয়, তাহলেই কেবল ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের দিকে এগোতে রাজি হবে মস্কো।
পুতিনের শান্তি প্রস্তাব: শর্ত সাপেক্ষ
বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ সামরিক সংঘাতের সমাপ্তির ইঙ্গিত অনেকদিন পর এলেও তা নির্ভর করছে বেশ কিছু শর্তের ওপর। পুতিন চাচ্ছেন:
- ন্যাটো সম্প্রসারণ না করা—বিশেষ করে ইউক্রেন, জর্জিয়া ও মলদোভার মতো সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত না করা।
- ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে রাখা।
- রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা।
- পশ্চিমা দেশগুলোতে থাকা রুশ সম্পদ মুক্ত করা।
- ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
রাশিয়ার ভাষ্য, যদি এসব মূল দাবি পূরণ না হয়, তাহলে শান্তি চুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমনকি পুতিন আরও কঠোর সামরিক কৌশল নিতে পারেন, যাতে ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের অবস্থান দুর্বল হয় এবং আলোচনায় তাদের বাধ্য করা যায়।
ট্রাম্পের সক্রিয় ভূমিকা ও হতাশা
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ নেওয়ার পর তিনি একাধিকবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার প্রশাসন শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
তবে সাম্প্রতিক সময় ট্রাম্পের কণ্ঠে হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, পুতিন তার প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি কিছুদিন আগে দুই নেতার মধ্যে দুই ঘণ্টারও বেশি সময়ব্যাপী কথোপকথনের পর ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “শান্তি চাই, কিন্তু প্রতিপক্ষ বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি: সন্দেহ ও অবিশ্বাস
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের শান্তি প্রস্তাব একধরনের কৌশল মাত্র। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার আগ্রাসন এখনো অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক উপগ্রহচিত্র ও যুদ্ধ ময়দানের তথ্য অনুযায়ী, রুশ বাহিনী নতুন করে ডনবাস অঞ্চলে অগ্রসর হচ্ছে।
ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বলছেন, “পুতিন শান্তি চান, কিন্তু কোনো মূল্য দিয়ে নয়।” তাদের সন্দেহ, এই ধরনের শর্তযুক্ত শান্তি চুক্তি আসলে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা প্রভাব বিস্তার বজায় রাখতে চায়।
ইউক্রেনের অবস্থান: স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন
ইউক্রেন বারবার বলছে, ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা একটি সার্বভৌম অধিকার এবং রাশিয়ার কোনো ভেটো ক্ষমতা এতে থাকতে পারে না। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এখনও এই বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি, তবে তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো চুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
কিয়েভের ভাষ্য, ভবিষ্যতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের হামলা ঠেকাতে পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ও নিরাপত্তা গ্যারান্টি জরুরি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: মিশ্র বার্তা
✔ জার্মানি ও ফ্রান্সের অবস্থান:
তারা পুতিনের প্রস্তাবকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনার আহ্বান জানালেও ন্যাটো সদস্যভুক্তির প্রশ্নে এখনো নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি।
✔ পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ:
এই প্রস্তাবকে তারা “আধুনিক কূটনৈতিক ব্ল্যাকমেইল” বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, এর মাধ্যমে রাশিয়া আবারও পূর্ব ইউরোপে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
পেছনের প্রেক্ষাপট: যুদ্ধের মূল কারণ কী?
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। মূল দাবি ছিল—ন্যাটো পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই যুদ্ধ তিন বছরের মধ্যে হাজারো প্রাণহানি, লাখো শরণার্থী ও বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ইতোমধ্যে বিশ্বে খাদ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করেছে।
বাস্তব শান্তি নাকি কৌশলগত চাল?
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শর্তগুলো শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে একটি সম্ভাব্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে—এমনটি যেমন বলা হচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ বলছেন, এটি কেবলমাত্র “রাজনৈতিক চাপ তৈরির হাতিয়ার”।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের এক তরুণ সংসদ সদস্য বলেন, “আমরা শান্তি চাই, তবে দাসত্বের বিনিময়ে নয়। সার্বভৌমত্ব আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।”