আরবি ভাষায় এআই মডেল নিয়ে এল সংযুক্ত আরব আমিরাত

আধুনিক বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI) খাতটি যে এক অভূতপূর্ব প্রতিযোগিতার মঞ্চে রূপ নিয়েছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলো যেখানে এআই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোও। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এমনই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে হাজির হয়েছে—আরবি ভাষায় তৈরি একটি নিজস্ব এআই মডেল, যার নাম ‘ফ্যালকন অ্যারাবিক’।
আরবি ভাষায় সম্পূর্ণ নেটিভ ডেটাসেটে নির্মিত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড টেকনোলজি রিসার্চ কাউন্সিল (ATRC) এই মডেলটির বিকাশে নেতৃত্ব দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই এআই মডেলটি নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল আরবি ভাষার প্রকৃত বৈচিত্র্যকে ধারণ করা এবং এটি করতে গিয়ে তারা কোনো অনুবাদ বা বহিরাগত ভাষার ওপর নির্ভর করেনি। এটি সম্পূর্ণরূপে নেটিভ আরবি ডেটাসেটের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র আরব বিশ্বের ভাষাগত প্রয়োজনীয়তাকে সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম।
‘ফ্যালকন অ্যারাবিক’ এর কর্মক্ষমতা
প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফ্যালকন অ্যারাবিক’ এর কর্মক্ষমতা এমনভাবে গঠিত হয়েছে যে এটি ১০ গুণ বড় অন্যান্য এআই মডেলগুলোর সমপর্যায়ে কাজ করতে পারে। প্রযুক্তিগত পরিশীলনের মাধ্যমে এটিকে দক্ষ, নির্ভরযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে। এটিআরসি’র সেক্রেটারি জেনারেল ফয়সাল আল বনানি বলেন, “আজকের দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব মানে শুধু বড় প্রযুক্তি নির্মাণ নয়, বরং তা হওয়া উচিত কার্যকর, ব্যবহারযোগ্য এবং সর্বজনীনভাবে উপযোগী।”
ফ্যালকন এইচ১: প্রতিযোগীদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে
‘ফ্যালকন অ্যারাবিক’-এর পাশাপাশি ATRC ‘ফ্যালকন এইচ১’ নামে আরও একটি শক্তিশালী মডেল উন্মোচন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এই মডেলটি মেটা এবং আলিবাবা-র মতো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি এআই মডেলকেও পারফরম্যান্সে ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এটি পরিচালনার জন্য প্রচলিত এআই সিস্টেমগুলোর মতো অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত শক্তি বা ব্যয়বহুল কম্পিউটিং পাওয়ারের প্রয়োজন হয় না। এর ফলে এটি আরও পরিবেশবান্ধব, সহজলভ্য এবং ব্যবহারবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এআই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে ইউএই
বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত বিগত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। দেশটি বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে বিভিন্ন গবেষণা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে। তাদের লক্ষ্য হলো—শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও নিজেদের একটি শক্তিশালী এআই প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক ইউএই’র জন্য একটি বিশেষ সুবিধা হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত প্রযুক্তি আমদানির পাশাপাশি, ইউএই এখন সেমিকনডাক্টরসহ উচ্চমানের প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুমতি পেতে যাচ্ছে।
ট্রাম্পের সফর ও চুক্তির সম্ভাবনা
গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, এআই প্রযুক্তি খাতে একটি মার্কিন-ইউএই চুক্তি হলে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি উন্নত সেমিকনডাক্টর প্রযুক্তি ইউএই ব্যবহার করতে পারবে। এই চুক্তি সম্পাদিত হলে ইউএই’র প্রযুক্তি খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সৌদি আরবেরও একই লক্ষ্য
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে এআই প্রযুক্তি নিয়ে তৎপরতা শুধু ইউএই-তেই সীমাবদ্ধ নয়। সৌদি আরবও এই খাতে নিজেদেরকে একটি আঞ্চলিক নেতৃত্বের আসনে বসাতে চায়। চলতি মাসের শুরুতেই তারা এআই খাতে উন্নয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি মাল্টিমডাল লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (LLM) তৈরি করতে চায়, যা আরবি ভাষাভাষীদের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হবে।
ভাষাগত অন্তর্ভুক্তিতে এক ধাপ এগিয়ে
বিশ্বের প্রধান সব এআই মডেল এখনো ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক। ফলে বহুভাষিক বিশ্বের জন্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার অনেক সময় সীমিত বা আংশিক সুবিধা প্রদান করে। এই প্রেক্ষাপটে ইউএই’র উদ্যোগ আরবি ভাষাভাষীদের জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এটি শুধু ভাষার অন্তর্ভুক্তিকেই ত্বরান্বিত করছে না, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমেই একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরছে।
সমাপ্তি কথা
‘ফ্যালকন অ্যারাবিক’ এবং ‘ফ্যালকন এইচ১’ মডেলের আত্মপ্রকাশ এটাই প্রমাণ করে যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত। তারা কেবল ভোক্তা নয়, এখন উদ্ভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এটি এআই খাতে বৈশ্বিক ভারসাম্য ও প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল এবং ভাষাগতভাবে বৈচিত্র্যময় সমাজগুলোর জন্য এটি হতে পারে এক যুগান্তকারী অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।