বিশ্ব

দক্ষিণ কোরিয়ায় ভয়াবহ দাবানলে নিহত ২৪

দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একাধিক দাবানলে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও ২৬ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশের বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

‘অবর্ণনীয় সংকট’ হিসেবে দাবানলকে আখ্যা

দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু এই দাবানলকে ‘অবর্ণনীয় সংকট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এটি দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দাবানল। তিনি আরও বলেন, “এই দাবানল জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলের রেকর্ড বই পুনর্লিখন করছে।” কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ও ব্যাপক দাবানলগুলোর একটি।

ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস

দাবানলের ফলে ১,৩০০ বছরের পুরনো উইসিওং শহরে অবস্থিত গাউনসা মন্দির সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। এই মন্দিরটি ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে পরিচিত। এছাড়া, জোসিয়ন রাজবংশ (১৩৯২-১৯১০) থেকে আসা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনও আগুনে ধ্বংস হয়েছে।

দাবানলের বিস্তার

গত শুক্রবার সাঞ্চেওং জেলায় দাবানল শুরু হয় এবং দ্রুত এটি গিওংবুক, উইসিওং, আন্দং, চিয়ংসং, ইয়ংইয়াং এবং সাঞ্চেওং জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। শক্তিশালী ও শুষ্ক বাতাসের কারণে আগুন অত্যন্ত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে, যা অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।

অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম

অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার সামরিক সদস্য ও হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী মাঠে নেমেছেন। মার্কিন সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তবে বাতাসের তীব্রতার কারণে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দাবানল নেভাতে বৃষ্টির ওপর কিছুটা আশা করা হচ্ছে, তবে অঞ্চলটিতে বৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই কম।

অগ্নিনির্বাপক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা

বুধবার উইসিওংয়ের পার্বত্য অঞ্চলে একটি অগ্নিনির্বাপক হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হলে এর পাইলট নিহত হন। এখনও পর্যন্ত দুর্ঘটনার কারণ তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

দাবানলের ভয়াবহতা

দক্ষিণ কোরিয়া তার ইতিহাসে এত ভয়াবহ দাবানল খুব কম দেখেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর (৪২ হাজার একর) বনাঞ্চল সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম দাবানল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা বলেছেন, তাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাদের জীবনযাত্রার চিরাচরিত ধারা একেবারেই বদলে গেছে। এছাড়া, স্থানীয় বিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি ভবনগুলোতে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দাবানলের গতি বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

সরকারের প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার অবৈধভাবে আগুন লাগানো ও ব্যক্তিগত অবহেলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া, এ বছর এখন পর্যন্ত দেশটিতে ২৪৪টি দাবানল ঘটেছে, যা গত বছরের তুলনায় ২.৪ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ায় দাবানলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এই সংকট আরও ভয়াবহ হতে পারে।

সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে তারা যথাযথ সাহায্য পাচ্ছেন না। এদিকে, উদ্ধারকর্মীরা বলেছেন, তারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন, তবে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

দাবানলের কারণ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় চলতি বছর শুষ্ক আবহাওয়া এবং তীব্র বাতাসের কারণে দাবানলের প্রকোপ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বনাঞ্চলে মানুষজনের অসতর্কতা থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে এবারের দাবানল কতটুকু প্রাকৃতিক এবং কতটুকু মানবসৃষ্ট, তা এখনো তদন্তাধীন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার দাবানলের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ জাপান ও চীনও দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছে।

এদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, এই ধরনের দাবানল পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে শুধুমাত্র বনাঞ্চলই পুড়ে যাচ্ছে না, বরং বন্যপ্রাণী, বাস্তুতন্ত্র ও মানব স্বাস্থ্যেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে।

উপসংহার

দক্ষিণ কোরিয়ায় চলমান দাবানল একটি জাতীয় বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, বহু প্রাণহানি ঘটেছে এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস হয়েছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করলেও পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও অসতর্কতার কারণে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দাবানলের সম্মুখীন হতে পারে দেশটি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button