চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে ৫৬০ কোটি মানুষ, নিজেকে রক্ষা করবেন যেভাবে

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে নতুন সতর্কতা। বিশ্বের ১১৯টি দেশের ৫৬০ কোটি মানুষ রয়েছে ঝুঁকিতে। কীভাবে এই ভাইরাস ছড়ায়, কী উপসর্গ দেখা দেয় এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যায়—জেনে নিন বিস্তারিত।
চিকুনগুনিয়া নিয়ে ডব্লিউএইচও’র সতর্কতা
বিশ্বজুড়ে মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর নাম এখন চিকুনগুনিয়া। এই ভাইরাস নতুন করে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও’র চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ানা রোহাস আলভারেজ জানিয়েছেন, বর্তমানে বিশ্বের ১১৯টি দেশে প্রায় ৫৬০ কোটি মানুষ চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব আবারও ২০০৫ সালের মতো বৈশ্বিক মহামারির রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
কোথা থেকে শুরু হলো নতুন প্রাদুর্ভাব?
২০২৫ সালের প্রথম দিকেই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপগুলো—বিশেষ করে লা রিইউনিয়ন, মায়োত ও মরিশাস—এ নতুনভাবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়।
লা রিইউনিয়নে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ইতোমধ্যে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মাদাগাস্কার, সোমালিয়া, কেনিয়া, এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও।
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হলো, ইউরোপেও এখন স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ফ্রান্স ও ইতালিতে এমন বেশ কয়েকটি রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে যারা দেশ ত্যাগ না করেই আক্রান্ত হয়েছেন।
অতীতের প্রেক্ষাপট: ২০০৫ সালের ভয়াবহতা
২০০৪-০৫ সালে প্রথমবার বড় পরিসরে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছোট দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে শুরু হলেও, পরে তা আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপে ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করে।
ওই সময় প্রায় ৫ লাখ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন।
কীভাবে ছড়ায় চিকুনগুনিয়া?
চিকুনগুনিয়া মূলত ছড়ায় এডিস প্রজাতির মশার মাধ্যমে। এই মশা দিনের বেলা সক্রিয় থাকে এবং ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাসের মতো অন্যান্য ভাইরাসও ছড়ায়।
চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি মশার কামড় খেলে সেই মশার মাধ্যমে ভাইরাসটি অন্য মানুষে ছড়ায়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং জমে থাকা পানিই মশা বিস্তারের বড় কারণ।
চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ কী?
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত যেসব উপসর্গ দেখা যায়, তা হলো:
- হঠাৎ করে উচ্চমাত্রার জ্বর
- অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা (যা কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে স্থায়ী হতে পারে)
- মাথাব্যথা
- শরীর দুর্বলতা
- পেশিতে ব্যথা
- চুলকানিসহ ত্বকে লালচে র্যাশ
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া
কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গ এতটাই তীব্র হয় যে রোগী চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, এবং লম্বা সময় অক্ষমতা ভোগ করে।
চিকুনগুনিয়ার কোনো চিকিৎসা বা টিকা আছে কি?
এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক বা টিকা এখনো পর্যন্ত বাজারে আসেনি। আক্রান্ত হলে শুধুমাত্র উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়—যেমন প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, প্রচুর পানি পান এবং বিশ্রাম।
গবেষকরা চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে টিকা তৈরির কাজ করলেও তা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
নিজেকে রক্ষা করবেন যেভাবে
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এজন্য নিচের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চলা জরুরি:
- দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করুন
- ঘুমানোর সময় আবদ্ধ ঘর ব্যবহার করুন
- লম্বা হাতা ও পা ঢাকা পোশাক পরুন
- মশা তাড়ানোর লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করুন
- বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখুন
- ফুলদানি, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদিতে পানি জমতে দেবেন না
- বাথরুম, রান্নাঘর, ছাদ, বারান্দা নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন
বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের এডিস মশার কামড় থেকে বাঁচাতে বাড়তি সচেতনতা প্রয়োজন।
চিকিৎসকের মতামত: সচেতনতা জরুরি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একাধিক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশার বিস্তার এখন পৃথিবীর আরও বেশি অঞ্চলে হচ্ছে। ফলে যেসব দেশে আগে চিকুনগুনিয়া ছিল না, সেখানেও এখন এই ভাইরাস পৌঁছে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জানান, “বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মতো ভাইরাস বাড়লেও চিকুনগুনিয়া নিয়েও আমাদের এখন থেকে সজাগ হতে হবে। কারণ, এডিস মশার পরিবেশ এখানে বিদ্যমান এবং আমরা যদি ব্যবস্থা না নেই, তাহলে খুব সহজেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
সারসংক্ষেপ
বিশ্বজুড়ে ৫৬০ কোটি মানুষ এখন চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে। যদিও এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা আবারও ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে।
এ ভাইরাসের এখনো কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক না থাকায় সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র উপায়।
প্রশ্ন হলো—আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত? আমাদের কি এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়, যাতে ২০০৫ সালের মতো পরিস্থিতি আবার ফিরে না আসে?
এম আর এম – ০৪৯২ , Signalbd.com