বিশ্ব

প্রতি ২০ মিনিটে গাজায় এক শিশু নিহত বা আহত

গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি হামলায় প্রতি ২০ মিনিটে গড়ে একটি শিশু নিহত কিংবা গুরুতর আহত হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ এই ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি শিশু প্রাণ হারিয়েছে বা আহত হয়েছে। তারা এ পরিস্থিতিকে ‘শৈশব ও জীবনের সম্পূর্ণ ধ্বংস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

গাজায় শিশুদের নিধনযজ্ঞ: প্রতিটি পরিসংখ্যানই এক একটি শিশুর জীবন

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এক আবেগঘন বিবৃতিতে বলেন,

“মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন, অবরুদ্ধ ত্রাণ, ক্ষুধা, ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িঘর, স্কুল ও হাসপাতাল—এ সবকিছু শিশুদের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরা শুধুই সংখ্যা নয়, এরা শিশু। এভাবে কোনো শিশুর বেঁচে থাকার কথা নয়। আর একটি শিশুও যেন না হারায়।”

প্রতি ঘণ্টায় তিনটি শিশুর মৃত্যু বা আহত হওয়ার আশঙ্কা

ইউনিসেফ জানিয়েছে, গড়ে প্রতি ২০ মিনিটে একটি শিশু আহত বা নিহত হচ্ছে, অর্থাৎ দিনে প্রায় ৭২ শিশু এই বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।
বিশেষ করে গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর ১ হাজার ৩০৯ জন শিশু নিহত এবং ৩ হাজার ৭৩৮ জন আহত হয়েছে

শুধু গত সপ্তাহান্তে দু’টি বড় হামলায় বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একটি হামলায় খান ইউনিস এলাকার আল-নাজ্জার পরিবারের প্রায় সব শিশুই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে। ১২ বছরের নিচে থাকা ১০ ভাইবোনের মধ্যে মাত্র একটি শিশু বেঁচে আছে, তাও গুরুতর আহত অবস্থায়। অন্যদিকে, সোমবার ভোরে গাজা সিটির একটি স্কুলে চালানো হামলায় ১৮ জন শিশু সহ অন্তত ৩১ জন নিহত হয়।

শিশুর মুখে না আছে হাসি, না আছে খাদ্য

ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি ছবি এখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুই বছর বয়সী আলমা, যার চোখে শোক, ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। মার্চ ২০২৫-এ গাজার আল–রিমাল এলাকার ওমর আল–মুখতার সড়কে তোলা ছবিটি আজকের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

শিশুদের জন্য খাদ্য, পানি, চিকিৎসা নেই: জোরপূর্বক অনাহার

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজার শিশুরা শুধু বোমা নয়, অনাহার ও অপুষ্টির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বহু শিশু খাবারের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, “শিশুরা এক দীর্ঘ, বিভীষিকাময় তালিকার অংশ হয়ে গেছে।”

গাজায় জরুরি চিকিৎসা, পরিশুদ্ধ পানি, খাদ্য এবং মানবিক সহায়তার প্রবেশও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত বা অবরুদ্ধ।

ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছে যুদ্ধ

ইউনিসেফ আরও জানিয়েছে, গাজার স্কুল, হাসপাতাল, পানি সরবরাহব্যবস্থা, ঘরবাড়ি—সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শিশুরা শুধু বর্তমানে নয়, ভবিষ্যতেও ভয়াবহ সংকটে পড়বে।

আঞ্চলিক পরিচালক এদুয়ার বেগবেদে বলেন,

“শুধু জীবন নয়, শিশুদের ভবিষ্যৎও নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে এই সহিংসতা।”

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতায় ক্ষুব্ধ ইউনিসেফ

বিবৃতিতে বলা হয়,

“আর কত শিশুর লাশ দরকার? আর কত সরাসরি সম্প্রচারিত ভয়াবহতা দেখতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে? তারা কবে সাহসী সিদ্ধান্ত নেবে?”

জাতিসংঘ একাধিকবার সমস্ত পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে আহ্বান জানিয়েছে।

যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই: ইউনিসেফের বার্তা

বিবৃতিতে ইউনিসেফ বলেছে,

“শিশুদের দরকার নিরাপত্তা, খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং যুদ্ধবিরতি। কিন্তু এর চেয়েও বড় প্রয়োজন হলো—এই নিষ্ঠুরতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা।”

কেন বিশ্ব এখনও নীরব?

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের চরম লঙ্ঘন।
তবুও বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এখনো দ্ব্যর্থবাচক বক্তব্যের বাইরে গিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ ধরনের নীরবতা শুধুই হামলার সুযোগ তৈরি করছে।

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিন্তু ইসরায়েলি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক অবস্থান গড়ে উঠছে না।

ইউনিসেফের দাবি ও আহ্বান:

১. সব যুদ্ধরত পক্ষকে শিশুদের রক্ষা করার আহ্বান।
২. মানবিক সহায়তার প্রবেশ অবিলম্বে নিশ্চিত করা।
৩. সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া।
৪. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন মেনে চলা।
৫. দ্রুত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা।

গাজার শিশুরা এখন কেবল সহিংসতার শিকার নয়, বরং এক নিঃসীম দুর্দশার প্রতীক। প্রতি ২০ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু বা আহত হওয়ার এই পরিসংখ্যান কোনো সংখ্যার খেলা নয়—এটা এক একটি পরিবারের অসহনীয় বেদনার প্রতিচ্ছবি।

সম্ভব হলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই সোচ্চার হওয়া উচিত।
গাজার শিশুদের বাঁচাতে এখনই চাই যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা এবং ন্যায়বিচার।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button