বিশ্ব

পুতিনের সাথে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’র জন্য রাশিয়া যাচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ায় পুতিনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে ইরান ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। ২০২৫ সালের ২২ জুন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ করার জন্য ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি আজ মস্কোর উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। কাতারভিত্তিক খ্যাতিমান সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাঘচি জানান, যদিও আজই রাশিয়ায় পৌঁছেছেন, তবে আলোচনাটি আগামীকাল ২৩ জুন সোমবার অনুষ্ঠিত হবে। মস্কো সফরকে তিনি কৌশলগত বন্ধুত্ব ও অংশীদারিত্বের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ইরান-রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক ও সমন্বয়

ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আব্বাস আরাঘচি বলেন, “রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। আমরা কেবল বন্ধুই নই, বরং কৌশলগত অংশীদার। আমরা সবসময় একে অপরের সমস্যা ও পারস্পরিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, পরামর্শ গ্রহণ করি এবং আমাদের অবস্থানের সমন্বয় সাধন করি।” তিনি আরও বলেন, “রাশিয়া জেসিপিওএ (JCPOA) স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাই আমাদের সহযোগিতা সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এই পরিদৃশ্যে, আগামীকালের আলোচনায় দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন এবং একযোগে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার জানাবেন।

ইরানের প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা: পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং ইসরায়েলের প্রতিহিংসা

গত রাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমারু বিমান হামলার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন অস্থিরতা তৈরি করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করে জানান, “এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন।” তিনি সতর্ক করে দেন, “যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার ‘চিরস্থায়ী পরিণতি’ ভোগ করবে।”

আরাঘচি আরও বলেন, ইরান তার সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ এবং জনগণকে রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কোনো ধরনের আক্রমণ মাথা নিচু করে সইব না।”

এই উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় ইরান ফৌজ ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে মিসাইল হামলা চালায়, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

জেসিপিওএ: ইরান এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু নিয়ন্ত্রণ চুক্তির গুরুত্ব

জেসিপিওএ, অর্থাৎ ‘পরমাণু বিষয়ক যৌথ সম্মিলিত কর্মসূচি’ হলো ২০১৫ সালে ইরান এবং বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এর মাধ্যমে ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে বলা হয়, যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা বন্ধ থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানি এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ।

তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে একপক্ষীয়ভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানও চুক্তির কিছু অংশ অনুসরণ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

রাশিয়ার সাথে ইরানের সমঝোতা ও অংশীদারিত্ব জেসিপিওএ’র পটভূমিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ রাশিয়া ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং পরমাণু বিষয়ক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইরান-রাশিয়া: কৌশলগত বন্ধুত্বের বহুমাত্রিক দিক

ইরান এবং রাশিয়ার সম্পর্ক শুধুমাত্র কূটনৈতিক নয়, তা অর্থনৈতিক, সামরিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত।

  • অর্থনৈতিক সহযোগিতা: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে ইরান রাশিয়ার সঙ্গে তেল, গ্যাস এবং বাণিজ্যিক চুক্তি বাড়িয়ে নিচ্ছে।
  • সামরিক অংশীদারিত্ব: দুদেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় চলছে।
  • ভূ-রাজনৈতিক সমর্থন: সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দ্বন্দ্ব অঞ্চলে দুদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দৃঢ়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অংশীদারিত্বে ইরান ও রাশিয়া পশ্চিমা প্রভাব মোকাবেলায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক রাজনৈতিক ধাঁধা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান হামলা, ইরানের মিসাইল প্রতিহিংসা, এবং রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক আলোচনা — এই সব ঘটনার সমন্বয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এই অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ নিশ্চিত করতে নানা ভাবে জড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ করণীয়

  • ইরান-রাশিয়া সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মিশ্রণ ঘটবে।
  • পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ইরান-রাশিয়ার অংশীদারিত্ব তাদের প্রভাব কমাতে পারে।
  • মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।
  • জাতিসংঘের মাধ্যমে জেসিপিওএ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা দরকার।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button