অর্থনীতি

চিংড়ি রপ্তানি খাতে সংকট: অপদ্রব্য পুশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিযোগিতা

বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি খাত এক সময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় শীর্ষ খাত হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে নানা কারণে এই খাতের অবস্থান বর্তমানে ১০ নম্বরে নেমে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা না মেনে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ, উৎপাদন কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পোনা সংকটসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি খাত দিন দিন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রপ্তানির পরিসংখ্যান ও বর্তমান অবস্থা

২০২৩-২৪ অর্থবছরের শীর্ষ ১০ রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই অর্থবছরে শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৮০ শতাংশ। অন্যান্য পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। এই অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এরপর রয়েছে কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কটন ও কটন পণ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ফুটওয়্যার (চামড়া ব্যতীত) পণ্য এবং সর্বশেষ ১০ নম্বরে রয়েছে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) সূত্র বলেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল; যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৫১ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি কমে ৪০ হাজার ৭২৬ টনে দাঁড়ায়। এভাবে গত ১০ বছরে রপ্তানির পরিমাণ কমেছেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে।

অপদ্রব্য পুশের প্রভাব

বিএফএফইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম জহীর বলেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢোকাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুশ’। এ ধরনের প্রবণতা রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত। তিনি বলেন, গত ১৪ এপ্রিল এ নিয়ে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বিএফএফইএর বৈঠক হয়। ওই সভায় রপ্তানিকারকেরা প্রতিটি প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিকে হেড লেস (মাথাবিহীন) গলদা ও বাগদা চিংড়ি না কেনার আহ্বান জানান। পাশাপাশি অসাধু কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও উৎপাদন কমে যাওয়া

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে চিংড়ির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘চিংড়ি উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি আমাদের নেই। তা ছাড়া একজন চিংড়িচাষি একবার মার খেলে তাঁর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। কৃষকদের শস্যবিমা থাকলেও মৎস্যজীবীদের তা নেই। তাঁরা বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভর্তুকি পান না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিংড়ি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনা অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি নদ-নদীতে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির অসাধু জেলে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের জলজ জীববৈচিত্র্য। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনসংলগ্ন বৃহত্তর খুলনা জেলার নদ-নদীর মাছের ওপরেও।

মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম

মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল মামুন বলেন, মাছের প্রধান বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বৃহত্তর খুলনা জেলার নদ-নদীতেও মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন কমে গেছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সুন্দরবন বন বিভাগ যৌথভাবে কাজ করলে মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বাড়ানো হয়তো সম্ভব।

ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ

চিংড়ি রপ্তানি খাতের উন্নতির জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশ করা যেতে পারে:

  • উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার: চিংড়ি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
  • কৃষকদের জন্য বিমা: মৎস্যজীবীদের জন্য শস্যবিমার মতো বিমা ব্যবস্থা চালু করা।
  • বিদ্যুৎ ভর্তুকি: মৎস্যজীবীদের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করা।
  • অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: অপদ্রব্য পুশের মতো অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি খাতের উন্নতির জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র এককভাবে কোনো পক্ষই এই খাতের উন্নতি সাধন করতে পারবে না। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই খাতের উন্নতি সম্ভব।

MAH – 12780,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button