জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বিপর্যস্ত চাল উৎপাদন, সমাধান প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এ গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য এখন বৈশ্বিক সংকটে। খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তীব্র তাপপ্রবাহে এশিয়ায় ধানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। এই সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ও নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের প্রয়াস।
চালনির্ভর বিশ্বের মুখে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা
বিশ্বে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ তাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে চালের ওপর নির্ভরশীল। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা। অথচ বিশ্বের ৯০ শতাংশ চাল উৎপাদনকারী অঞ্চল এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় খরা ও অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত ধানের উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
ফলস্বরূপ, বিভিন্ন দেশে চালের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। যেমন জাপানে চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার তাদের জাতীয় মজুদের ১ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল নিলামে তুলেছে। ফিলিপাইনে খাদ্য সংকট অবস্থা (Food Security Emergency) ঘোষণা করা হয়েছে এবং সরকারের সংরক্ষিত চাল বাজারে ছাড়া হয়েছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশও নতুন করে ১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ধানচাষের ঘোষণা দিয়েছে—যা লন্ডনের আকারের ছয়গুণ।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষির নতুন পথ
জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা ধান উৎপাদনে প্রযুক্তিনির্ভর ও সহনশীল জাত উদ্ভাবনে নিরলস কাজ করছেন। ২০২১ সালে ফিলিপাইন বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ জিনগতভাবে পরিবর্তিত ‘গোল্ডেন রাইস’-এর অনুমোদন দেয়। এই ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অপুষ্টিজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড-এর উদ্ভিদ কোষ সংকেত বিজ্ঞানী অধ্যাপক জুলি গ্রে ও তাঁর দল এমন ধানের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন, যেগুলো খরা ও তাপপ্রবাহে টিকে থাকতে পারে। তাঁরা স্টোমাটা (পাতার ক্ষুদ্র রন্ধ্র) কম এমন গাছ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন, যাতে জল কম খরচ করে ধান চাষ সম্ভব হয়। কারণ, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, যা ধান গাছের পানির চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
তবে গ্রে ও তাঁর সহকর্মীরা সরাসরি জিন পরিবর্তনের পরিবর্তে সিলেক্টিভ ব্রিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, যাতে সাধারণ মানুষের জিএমও-সংক্রান্ত উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হয়। তিনি থাইল্যান্ডের গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন, যদিও এখনো স্বাদে এ নতুন ধান প্রাকৃতিক ধানের মতো নয়—এই জায়গায় আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ধান চাষে রোবট, ড্রোন ও স্যাটেলাইট
চাষাবাদের প্রযুক্তিগত রূপান্তর শুধু ধানের জাতে নয়, ধান চাষের পদ্ধতিতেও এসেছে বিপ্লব। এখন ধান রোপণ, সার প্রয়োগ, আগাছা চিহ্নিতকরণ ও জমির পুষ্টিমান নির্ধারণের মতো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। ফলে চাষাবাদ আরও নিখুঁত, সময় ও শ্রম সাশ্রয়ী হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী কৃষিকাজে শ্রমিক সংকট বাড়ছে। শহরমুখী মানুষের প্রবণতায় গ্রামে শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকের খরচ বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো ও পরিবেশ রক্ষা দুটোই সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্বের দরিদ্র কৃষকদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করতে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সংস্থা (IRRI) চালু করেছে “ড্রোন ফর রাইস” প্রকল্প। গত বছর ফিলিপাইনে এই প্রকল্প পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় এবং ইতোমধ্যে তা সফল বলছেন স্থানীয় কৃষকেরা। তবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গেলে সময় ও বিশাল পরিকাঠামো প্রয়োজন।
এছাড়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধানখেত চিহ্নিত করা, মিথেন নির্গমন নিরূপণ ও ফলনের পূর্বাভাস দিতেও বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। যুক্তরাজ্যের সারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. বেলেন মার্টি-কারডোনা বলেন, ‘আমাদের মাটি, আবহাওয়া, জলাবদ্ধতা এবং তাপমাত্রাসহ নানা তথ্য প্রয়োজন হয়, যা স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণেই পাওয়া যাচ্ছে।’
ধান চাষই আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ!
এক চমকপ্রদ তথ্য হলো, ধানের প্রচলিত চাষপদ্ধতিই জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় উৎস। চিরাচরিত পানিতে ডুবে থাকা ধানক্ষেত থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি ক্ষতিকর। গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী মিথেন নির্গমনের প্রায় ১২% আসে ধানক্ষেত থেকেই।
এছাড়া ধান চাষে পানির অপচয়ও ব্যাপক। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রয়োজন প্রায় ২,৫০০ লিটার পানি—যা ১৬টি বাথটাবের সমান। এমন পানিনির্ভরতা ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করছে।
সমাধান হতে পারে ডাইরেক্ট সিডেড রাইস (DSR)
এই সংকট সমাধানে গবেষকেরা পরিবেশবান্ধব নতুন চাষপদ্ধতি “ডাইরেক্ট সিডেড রাইস” বা DSR-এ সম্ভাবনা দেখছেন। এখানে চারা রোপণের বদলে সরাসরি মাঠে বীজ বপন করা হয়, ফলে পানির ব্যবহার কমে যায় এবং মিথেন নির্গমনও হয় না বললেই চলে।
যুক্তরাজ্যের রথামস্টেড রিসার্চ সেন্টারের ড. স্মিতা কুরুপ বলেন, “আমরা এমন জাত বেছে নিয়েছি, যেগুলো পানিতে ভালো হয়, অথচ ধান আসলে অতটা পানি চায় না। শুষ্ক জমিতেও ধান চাষ সম্ভব।”
তিনি শুষ্ক জমিতে উপযোগী শত শত ধানজাত পরীক্ষার মাধ্যমে ফলনবান জাতগুলো নির্বাচনের কাজ করছেন, যাতে কৃষকের ফলনও না কমে এবং পরিবেশের ক্ষতিও না হয়। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রতিটি দেশের ধানের স্বাদ, ধানদানার গঠন ও রান্নার ধরন আলাদা। ফলে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য আলাদা জাত উদ্ভাবনের প্রয়োজন।
উপসংহার: প্রযুক্তিই পথ দেখাবে
জলবায়ু পরিবর্তন ধান চাষের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কিন্তু প্রযুক্তির হাত ধরেই মিলছে উত্তরণের পথ। বিজ্ঞানভিত্তিক জাত উদ্ভাবন, আধুনিক চাষপদ্ধতি, ড্রোন-স্যাটেলাইটের ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ মিলিয়ে একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব।
তবে প্রযুক্তির এই সুফল দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার ও বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থাগুলোকে। নইলে খাদ্য নিরাপত্তার বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।