অর্থনীতি

এবি ব্যাংকের ১,৯০৬ কোটি টাকার ভয়াবহ লোকসান

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংক ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে। ২০২৪ অর্থবছরে ব্যাংকটি সমন্বিতভাবে লোকসান করেছে ১ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালনগত দুর্বলতা, শীর্ষ পর্যায়ের অনিয়ম, এবং বৃহৎ খেলাপি ঋণের বোঝা এ লোকসানের প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

এ বিশাল লোকসানের ফলে এবি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাম্প্রতিক বৈঠকে গৃহীত হয়েছে।

আর্থিক প্রতিবেদনের চিত্র: লোকসানের রেকর্ড

২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এবি ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি লোকসান (EPS) হয়েছে ২১ টাকা ২৮ পয়সা, যা আগের বছরের এক টাকার EPS থেকে ভয়াবহ অবনতি নির্দেশ করে। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি ৯০ কোটি টাকার মুনাফা করলেও ২০২৪ সালে তা উল্টে গিয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি লোকসানে পরিণত হয়েছে।

শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (Cash Flow per Share) এর অবস্থাও উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালে যেখানে নগদ প্রবাহ ছিল ১০ টাকা ৯৮ পয়সা, সেখানে ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে মাইনাস ৪২ টাকা ২৩ পয়সায়। ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (Net Asset Value per Share – NAVPS) ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৭ টাকা ১৯ পয়সা রয়ে গেছে।

এজিএম ও রেকর্ড ডেট

এবি ব্যাংক ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় হাইব্রিড পদ্ধতিতে তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (AGM) অনুষ্ঠিত হবে। রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ জুন, যেদিনের বিনিয়োগকারীরা AGM-এ অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করবেন।

শীর্ষপর্যায়ের দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা

এক সময় দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় ও গ্রাহকপ্রিয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত এবি ব্যাংক আজ মারাত্মক আর্থিক সংকটে। এর পেছনে দায়ী করা হচ্ছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, ঋণ অনুমোদনে অনৈতিক সুবিধা, ও দুর্বল নজরদারি

এক সময় ব্যাংকটির উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পর্যায়ে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, যিনি বিএনপি সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্যাংকটি দীর্ঘদিন ধরে তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিভিন্ন সময় ঘনিষ্ঠ মহলের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় অবৈধ ঋণ বিতরণ এবং প্রভাবশালী গ্রুপকে ঋণ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

মোরশেদ খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ওয়াহিদুল হক, যিনি তাঁর চা-বাগানের পরিচালক ছিলেন, দীর্ঘ সময় এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলীজ্যেষ্ঠ আইনজীবী খায়রুল আলম চৌধুরী-সহ কয়েকজন চেয়ারম্যান পদে থাকলেও ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। সবাই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন

বর্তমানে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইজার এ চৌধুরী

বিশাল খেলাপি ঋণের বোঝা

এবি ব্যাংকের বিশাল লোকসানের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বৃহৎ অঙ্কের খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহকদের অধিকাংশই ঋণ পরিশোধ করছেন না বলে জানা গেছে। এ তালিকায় রয়েছে:

  • সিকদার গ্রুপ
  • আশিয়ান সিটি
  • বিল্ডট্রেড
  • মাহিন গ্রুপ
  • আমান গ্রুপ
  • এরশাদ ব্রাদার্স
  • মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (স্বাস্থ্যখাতের আলোচিত ঠিকাদার)
  • বেক্সিমকো গ্রুপ
  • সিটিসেল (মোরশেদ খানের মালিকানাধীন বন্ধ মোবাইল অপারেটর)

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণের টাকা আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী পরিচয়ে ঋণ নেয়া-র অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থ পর্যবেক্ষণ

এবি ব্যাংকের বিপর্যস্ত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে একটি পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে রেখেছে। কিন্তু তাতেও ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির অভাব এবং প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়াই এবি ব্যাংকের এই দুঃপরিণতির অন্যতম কারণ।

ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কী?

এবি ব্যাংকের ভয়াবহ লোকসান এবং স্থবিরতা প্রশ্ন তুলছে এই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখা নিয়েই। বিশেষ করে ব্যাংকটির ঋণ আদায় না হওয়া এবং আমানতকারীদের সুদ পরিশোধে ব্যর্থতা ব্যাংকটির ওপর গ্রাহক আস্থা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখন প্রয়োজন দ্রুত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, স্বচ্ছ পরিচালনা পর্ষদ, এবং খেলাপি আদায়ে কঠোরতা। না হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এবি ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি বা লাইসেন্স ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button