বিশ্ব

ইরানের পাশে পাকিস্তান, মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের আহ্বান

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান জোরালোভাবে ইরানের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইসলামি বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে একতাবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি যৌথ অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে ইসলামাবাদ।

শনিবার (১৪ জুন) পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেন, “আমরা ইরানের পাশে আছি এবং আন্তর্জাতিক সব মঞ্চে তাদের স্বার্থ রক্ষায় সমর্থন জানাব। মুসলিম উম্মাহর এখন সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, কারণ আজ যদি কেউ না জেগে ওঠে, তাহলে আগামীকাল হয়তো আর জেগে ওঠার সুযোগ থাকবে না।”

যৌথ কৌশলের প্রস্তাব ও মুসলিম ঐক্যের আহ্বান

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, ইসরায়েল বর্তমানে শুধু ফিলিস্তিন নয়, ইরান ও ইয়েমেনকেও সামরিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এমন অবস্থায় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যদি ঐক্যের অভাব থাকে, তবে সবাইকেই একদিন একই রকম আগ্রাসনের শিকার হতে হবে।

তিনি ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-কে অবিলম্বে জরুরি বৈঠক আহ্বানের আহ্বান জানান, যাতে মুসলিম বিশ্ব একটি সমন্বিত এবং শক্তিশালী কৌশল নির্ধারণ করে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মোকাবিলা করতে পারে।

পাকিস্তানের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। এটি ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর একটি নগ্ন আঘাত।”

তিনি আরও বলেন, “এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল যে বার্তা দিতে চাচ্ছে, তা শুধু ইরানকেই নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার প্রতি একটি হুমকি।”

পাকিস্তান সরকার ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে একটি লিখিত প্রতিবাদপত্র পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: সর্বশেষ পরিস্থিতি

শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানের একটি সামরিক ঘাঁটি ও একটি গোপন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এতে প্রায় ১০০ জনের অধিক মানুষ নিহত হন এবং আরও অনেকে আহত হন। ইরান তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার প্রতিক্রিয়া জানায় এবং বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের ১৫০টিরও বেশি সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনায় পাল্টা হামলা চালায়।

শনিবার (১৪ জুন) সকালেও ইরান নতুন করে কামিকাজে ড্রোন এবং আরও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে হামলা চালায়। সামরিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, এই সংঘাত এখনই থামছে না বরং আগামী ঘণ্টাগুলোতে আরও বিস্তৃত ও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

পাকিস্তান-ইরান কৌশলগত সম্পর্ক

পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দুই দেশের সম্পর্ককে গভীরতর করে তোলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে কিছু উত্তেজনা থাকলেও, দুই দেশই পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নিয়মিত আলোচনায় বসে থাকে। ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের এই প্রকাশ্য সমর্থন শুধু দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্ব নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের প্রতিফলন বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. খালেদ আহমেদ বলেন, “পাকিস্তানের এই অবস্থান শুধু ইসলামি ঐক্যের আহ্বান নয়, বরং তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থকেও রক্ষা করার কৌশল। পাকিস্তান চায় না যে, ইসরায়েলের আগ্রাসন ইরানের পর তাদের দিকেও ঘুরে আসুক।”

তিনি বলেন, “যদি ওআইসি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই যুদ্ধ আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করতে পারে এবং এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, যা পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

মুসলিম বিশ্ব কী করছে?

এখন পর্যন্ত তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তবে অধিকাংশ আরব দেশ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিবৃতি দেয়নি। এ অবস্থায় পাকিস্তানের সরাসরি বক্তব্য মুসলিম বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

উপসংহার

মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে একটি স্পর্শকাতর ও উদ্বেগজনক অধ্যায় তৈরি করেছে। পাকিস্তানের এই স্পষ্ট অবস্থান ও মুসলিম বিশ্বের প্রতি ঐক্যের আহ্বান একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত তৈরি করতে পারে যদি অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো দ্রুত এবং একতাবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির নিরসন এখন কেবল অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, বরং কূটনৈতিক ও যৌথ ইসলামি কৌশলের মাধ্যমেই সম্ভব। আর সে পথেই হয়তো বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button