পাবনায় মসজিদকে ঘিরে রক্তাক্ত সংঘর্ষ , ১৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট

পাবনার বেড়া উপজেলার তারাপুর গ্রামে মসজিদের বারান্দা নির্মাণ নিয়ে চলমান বিরোধ আবারো ভয়াবহ রূপ নিল। শুক্রবারের সংঘর্ষে গুরুতর আহত মো. হাদিস (৪০) শনিবার দুপুরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর খবরে গ্রামে ফের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ জনতা প্রতিপক্ষের অন্তত ১৫টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে ঘটনাস্থলে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
ঘটনার বিস্তারিত
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত হাদিস সাঁথিয়া উপজেলার করমজা গ্রামের বাসিন্দা হলেও শ্বশুরবাড়ি বেড়ার তারাপুর গ্রামে বসবাস করতেন। শুক্রবার সকালে নতুন মসজিদের বারান্দা নির্মাণের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। গুরুতর আহত পাঁচজনকে বগুড়া ও পাবনায় পাঠানো হয়। এর মধ্যে হাদিসকে বগুড়ায় ভর্তি করা হয় এবং সেখানে তিনি শনিবার দুপুরে মারা যান।
তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নতুন মসজিদের পক্ষের লোকজন প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা চালায়। বিকেল নাগাদ ১৫টিরও বেশি বাড়িতে আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে বেড়া মডেল থানা পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে এবং পরিস্থিতি শান্ত করে।
বেড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওলিউর রহমান বলেন, “হাদিসের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর গ্রামে ফের সহিংসতা শুরু হয়। অন্তত ১৫টি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। আমরা ঘটনাস্থলে আছি এবং বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এ ঘটনায় সেলিম নামের একজনকে আটক করা হয়েছে।”
সংঘর্ষের পটভূমি
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর আগে পুরনো মসজিদে মিলাদ মাহফিলের সময় কিয়াম পড়া নিয়ে গ্রামে বিরোধ শুরু হয়। এরপর ওই বিরোধ থেকে আলাদা হয়ে কিছু লোকজন প্রায় ১০০ গজ দূরে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ করে। এই দুই মসজিদের অনুসারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন মসজিদের বারান্দা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে উত্তেজনা আরও বাড়ে। শুক্রবার সকালে কাজ শুরু করলে পুরনো মসজিদের পক্ষ বাধা দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। লাঠিসোটা, দা, হাঁসুয়া দিয়ে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমবার পরিস্থিতি শান্ত করলেও শনিবার মৃত্যুর পর তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
নিহত ও আহতদের অবস্থা
ঘটনায় নিহত হাদিসের মৃত্যু গ্রামে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন জানায়, আহতদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হচ্ছে।
পুলিশের ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
ঘটনার পর পুলিশ ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা হচ্ছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় এখনও কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেয়নি।
ওসি ওলিউর রহমান বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তবে আমরা নিজ উদ্যোগে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করব। গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
গ্রামের সাধারণ মানুষ এই সহিংসতায় আতঙ্কিত। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি। অনেক পরিবার আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
বিশেষজ্ঞ মতামত
স্থানীয় সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধর্মীয় স্থাপনাকে কেন্দ্র করে এমন বিরোধ সামাজিক বিভক্তি তৈরি করছে। প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এমন সমস্যার সমাধান করা উচিত।
শেষ কথা
মসজিদের বারান্দা নির্মাণের মতো একটি ছোট ঘটনা থেকে শুরু হয়ে যে সহিংসতা দেখা দিল, তা গ্রামে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। একজনের মৃত্যু, অসংখ্য আহত এবং ১৫টি বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসীর মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রশাসনের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এম আর এম – ০৫৩৩, Signalbd.com