গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়ানোর পুরোনো খেলায় ট্রাম্প–নেতানিয়াহু

হোয়াইট হাউসে বৈঠকে বসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আলোচনায় উঠে এসেছে গাজার ভবিষ্যৎ, ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে পাঠানোর পরিকল্পনা ও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা। বিশ্লেষকরা একে বলছেন ‘জাতিগত নিধনের নীলনকশা’।
আলোচনার কেন্দ্রে গাজা: বিতর্কিত প্রস্তাব
হোয়াইট হাউসের ব্লু রুমে একান্ত বৈঠকে বসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আলোচনায় উঠে আসে একটি পুরোনো ও বিতর্কিত বিষয়—ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। ট্রাম্প বলেছেন, “গাজার বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টাতে আশপাশের দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন, এবং সেটা আমরা পাচ্ছি।”
নেতানিয়াহু এ পরিকল্পনার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, “যদি কেউ গাজায় থাকতে চায়, থাকুক। কিন্তু যদি কেউ চলে যেতে চায়, তাকে সেই সুযোগ দিতে হবে। গাজা যেন কারাগার না হয়, বরং একটি উন্মুক্ত অঞ্চল হয় যেখানে মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।”
পুরোনো খেলা, নতুন মুখ
ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব নতুন নয়। ইসরায়েল বহু বছর ধরে এ ধারণাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করে আসছে। একে কখনো বলা হয়েছে ‘স্বেচ্ছাচারী অভিবাসন’, কখনো বলা হয়েছে ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা’। তবে বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবতা ভিন্ন।
সাবেক ইসরায়েলি কূটনীতিক আলোন পিনকাস বলেন, “এই ধরনের আলোচনাগুলো অনেক সময়ই বাস্তব পরিকল্পনার রূপ নেয় না। কিন্তু এমন প্রস্তাব বারবার আসায় ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।”
আল–জাজিরার সাংবাদিক হামদা সালহুত স্পষ্ট করে বলেন, “এটি জাতিগত নিধনের একধরনের কৌশল। কোনো জনগোষ্ঠীকে তার নিজ ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”
যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই বিতর্কিত ঘোষণা
বর্তমানে কাতারে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে পরোক্ষ আলোচনা চলছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। এমন এক সংকটময় সময়ে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা আসায় বিশ্লেষকরা বিস্মিত।
হামাসের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা যুদ্ধবিরতির পক্ষে, কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে। গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে এবং সকল বন্দী মুক্তি দিতে হবে।”
তবে নেতানিয়াহুর বক্তব্য ভিন্ন। তিনি বলেন, “হামাস যদি গাজা ছাড়ে এবং আত্মসমর্পণ করে, তাহলেই কেবল যুদ্ধের ইতি টানা সম্ভব।”
ট্রাম্পের নোবেল পুরস্কার আকাঙ্ক্ষা
বৈঠকের একপর্যায়ে নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন, যার মাধ্যমে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এ নিয়ে ওয়াশিংটনের সাংবাদিকরা বিষয়টিকে ‘লোক দেখানো কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ মনে করছে, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান আরও মজবুত করতে এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে বাড়তি সুবিধা পেতে এ ধরনের আলোচনা সামনে আনছেন। শান্তি আলোচনার আড়ালে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক হিসাবও রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন অনেকেই।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা বলেছে, “ফিলিস্তিনিদের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিকভাবে জোরপূর্বক স্থানান্তর আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল হতে পারে।”
বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোতেও এ ইস্যু নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। বিবিসি, আল–জাজিরা ও নিউইয়র্ক টাইমস বিষয়টিকে ‘গাজা সংকটের নতুন মোড়’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
আসল উদ্দেশ্য কী?
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার মাধ্যমে ইসরায়েল গাজা উপত্যকার ভূখণ্ডে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ট্রাম্পের সহযোগিতা পেলে ইসরায়েল সেই লক্ষ্যে আরও এগিয়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. কামরুল হোসেন বলেন, “এই পরিকল্পনা শুধু একটি জনসংখ্যা পরিবর্তনের বিষয় নয়; এটি ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।”
সারসংক্ষেপ
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়ানোর পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার সেটি আরও সংগঠিত এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে উত্থাপিত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শান্তি আলোচনা চলার সময় এ ধরনের প্রস্তাব আলোচনার পরিবেশকেও জটিল করে তুলছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব—মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
এম আর এম – ০২৩১, Signalbd.com