স্থায়ী যুদ্ধবিরতির গ্যারান্টি পেলে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস

গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা পেলে ইসরায়েলি জিম্মিদের শিগগির মুক্তি দিতে প্রস্তুত হামাস। এই ইঙ্গিত দিয়েছেন গোষ্ঠীটির এক জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি বলেন, একটি ‘গুরুতর ও কার্যকর’ যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে তারা বন্দী বিনিময় চুক্তিতে যেতে প্রস্তুত।
মধ্যস্থতায় এগিয়ে মিশর ও কাতার, সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্র
বর্তমানে কায়রোতে মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় হামাসের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত। লক্ষ্য একটাই—গাজায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সংঘাত থামানো এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা।
তাহের আল-নুনুর বার্তা: যুদ্ধের ইতি টানলেই মুক্তি সম্ভব
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা তাহের আল-নুনু বলেন, “আমরা একটি গুরুতর বন্দী বিনিময় চুক্তিতে যেতে প্রস্তুত। শর্ত হলো যুদ্ধের সমাপ্তি, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং অবরুদ্ধ উপত্যকায় মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।”
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল নিজেই যুদ্ধবিরতির পথে বাধা তৈরি করছে। “বিষয়টা কেবল বন্দীর সংখ্যা নয়, বরং দখলদারদের প্রতিশ্রুতি না মানা এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই মূল সমস্যা,” — উল্লেখ করেন তাহের।
ইসরায়েলের প্রস্তাব: ১০ বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট এক প্রতিবেদনে জানায়, হামাসকে একটি নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোষ্ঠীটি যদি ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দীকে মুক্তি দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র গ্যারান্টি দেবে যে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে আলোচনা শুরু করবে।
এর আগে জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল, যা দুই মাস স্থায়ী ছিল। কিন্তু ইসরায়েলি আগ্রাসনের পুনঃসূচনা এবং একের পর এক শর্তারোপের কারণে আলোচনা ভেস্তে যায়।
‘অস্ত্র ত্যাগ নয়’— হামাসের দৃঢ় অবস্থান
তাহের আল-নুনু স্পষ্ট করে বলেন, “হামাস অস্ত্র ত্যাগ করবে না। এটি আলোচনার কোনো বিষয় নয়।” অথচ ইসরায়েলি পক্ষ এই অস্ত্র পরিত্যাগকেই যুদ্ধবিরতির প্রধান শর্ত হিসেবে তুলে ধরছে। হামাসের এই অবস্থান নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
৭ অক্টোবরের আগ্রাসন থেকে আজ পর্যন্ত
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়। সেদিন সকালে ইসরায়েল সীমান্তে হামলা চালায় হামাস। ইসরায়েলি তথ্য অনুযায়ী, সেই হামলায় ১ হাজার ২১৮ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৫৮ জন এখনো হামাসের কাছে বন্দী রয়েছেন, এবং ইসরায়েলি বাহিনীর মতে, এদের মধ্যে ৩৪ জন ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন।
গাজায় প্রাণহানির মর্মান্তিক চিত্র
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৭৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আর ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া চলমান যুদ্ধেই মোট প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজার ৯৪৪ জনে। এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান গাজার মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
আন্তর্জাতিক চাপ এবং সমাধানের সম্ভাবনা
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হামাসের পক্ষ থেকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে জিম্মিমুক্তির প্রস্তাব একটি কৌশলগত চাল হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে, ইসরায়েলকেও আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে এ চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা
হোয়াইট হাউসের একাধিক কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় যুদ্ধ থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চায়। হামাস এবং ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি বা আলোচনার সূচনা এখনো হয়নি।
গঠনমূলক চুক্তির আশা
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি এবং বন্দীমুক্তি বিষয়ক আলোচনায় বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমন্বয় করছে। তার ভাষায়, “আমাদের লক্ষ্য হলো ৯০ দিনের মধ্যে অর্থবহ চুক্তিতে পৌঁছানো।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে আমরা বিশ্বাস করি, কিছু দেশকে সঙ্গে নিয়ে চুক্তির পথ তৈরি করা সম্ভব।”
গাজায় যেকোনো যুদ্ধবিরতি উদ্যোগই নির্ভর করছে পারস্পরিক আস্থার ওপর। হামাস যদি তাদের অবস্থানে অনড় থাকে এবং অস্ত্র ত্যাগে অনিচ্ছুক হয়, ইসরায়েলের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন হবে। অন্যদিকে, হামাসের দাবিগুলো যদি ন্যায্য ও বাস্তবায়নযোগ্য হয়, আন্তর্জাতিক মহলের উচিত সেটিকে সমর্থন দিয়ে একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা।
বর্তমানে যুদ্ধবিরতির পথে আলোচনার জানালা খোলা আছে। এখন দেখার বিষয়—এই জানালাটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়, নাকি সংঘাতের দুঃসহ ইতিহাসই আবারো পুনরাবৃত্তি হয়।