আঞ্চলিক

টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী নৌকায় আগুন

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া টাঙ্গুয়ার হাওর বরাবরই পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য। কিন্তু শুক্রবার (৩০ মে) সন্ধ্যায় সেই সৌন্দর্যঘেরা পরিবেশে ঘটল এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। তাহিরপুর উপজেলার নিলাদ্রী লেকপাড় এলাকায় পর্যটকবাহী একটি নৌকায় হঠাৎ করে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও নৌকাটির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়দের সহায়তায় উদ্ধার অভিযান শুরু হলেও, আগুনের তীব্রতার কারণে তা যথেষ্ট বিলম্বিত হয়।

ঘটনার বিবরণ

শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন অধিকাংশ পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরের বিভিন্ন সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত, ঠিক তখনই নিলাদ্রী লেকপাড় এলাকায় থাকা একটি পর্যটকবাহী নৌকায় আগুন লাগে। নৌকাটিতে ঠিক কতজন পর্যটক ছিলেন সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য না মিললেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অন্তত ২০-২৫ জন যাত্রী থাকা সম্ভাবনা রয়েছে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আশপাশে থাকা অন্য নৌকাগুলোর পর্যটকরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, “ঘটনাস্থলে আমাদের একটি পুলিশ দল রওনা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তবে আগুনে নৌকার কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিংবা এতে ঠিক কতজন পর্যটক ছিলেন, তা তদন্তসাপেক্ষে বলা সম্ভব হবে।”

উদ্ধার অভিযান ও আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা

ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় মৎস্যজীবী ও মাঝিরা উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় তাহিরপুর ফায়ার সার্ভিস এবং থানা পুলিশের একটি দল। তবে আগুনের প্রচণ্ড তাপে নৌকার কাছাকাছি পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আগুন নেভাতে বেশ সময় লেগে যায়।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী আবদুর রহিম বলেন, “নৌকার সামনের দিক থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো নৌকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমরা ডিঙি নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তাপ এত বেশি ছিল যে কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি।”

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ফলে হাওরের সেই অংশে ভ্রমণরত পর্যটকদের মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেকেই নৌকা থেকে তীরে ফিরে আসেন, কেউ কেউ নিরাপদ দূরত্বে নৌকা নোঙর করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।

নৌকাটিতে থাকা পর্যটকদের অবস্থা

ঘটনার সময় নৌকাটিতে পর্যটক ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে কতজন ছিলেন, তারা কোথা থেকে এসেছেন এবং সবাই নিরাপদে উদ্ধার হয়েছেন কি না, সে সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়নি।

একজন স্থানীয় সাংবাদিক জানান, “নৌকাটিতে ঢাকা থেকে আসা পর্যটকদের একটি দল ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করেননি যে তারা ওই নৌকায় ছিলেন বা তাদের সদস্য কেউ নিখোঁজ।”

এদিকে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কেউ চিকিৎসার জন্য আসেননি, যা একটি স্বস্তিদায়ক খবর। তবে কিছু পর্যটক হালকা আঘাত বা ধোঁয়ায় অস্বস্তি বোধ করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রাথমিক অনুসন্ধান: কীভাবে আগুন লাগলো?

আগুন লাগার সঠিক কারণ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নৌকার ইঞ্জিন রুম বা রান্নার চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। পর্যটকদের জন্য ব্যবহৃত অনেক নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা থাকে এবং গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যবস্থার যথাযথ নিরাপত্তা না থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়।

তাহিরপুর থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন জানান, “আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত শুরু করব। ইঞ্জিনের ত্রুটি, গ্যাস লিকেজ, বা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট—সব দিক খতিয়ে দেখা হবে।”

টাঙ্গুয়ার হাওরে নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ

এই ঘটনাটি নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে হাওরে পর্যটক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে আসেন। কিন্তু বেশিরভাগ নৌকাতেই পর্যাপ্ত জীবনরক্ষা ব্যবস্থা বা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকে না। এমনকি নৌকা চালকদের নিরাপত্তা বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণও নেই।

স্থানীয় পর্যটন সংগঠন ‘টাঙ্গুয়ার বন্ধু’ এর সদস্য লতিফুর রহমান বলেন, “প্রতিবার দুর্ঘটনার পর আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তব উদ্যোগ চোখে পড়ে না। নৌকা রেজিস্ট্রেশন, নিরাপত্তা মানদণ্ড, পর্যটক তালিকা—সবই অনিয়মিতভাবে পরিচালিত হয়।”

তিনি আরও বলেন, “যদি নৌকাটিতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকত, তাহলে শুরুতেই আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। এটা পর্যটন খাতে বড় দুর্বলতা।”

প্রশাসনের উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

এই দুর্ঘটনার পর প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। একইসঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন নিয়ম-কানুন চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

এছাড়াও, প্রতিটি নৌকায় পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী উপকরণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এবং পর্যটক তালিকা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।

সাধারণ পর্যটকদের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর অনেক পর্যটক ভয় পেয়েছেন এবং ভ্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে হাওরের নৌকা ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে যারা পরিবার নিয়ে ঘুরতে যান, তারা আরও সতর্ক হয়েছেন।

একজন পর্যটক রুমানা ইসলাম বলেন, “আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আগামী সপ্তাহে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনার পর পরিবার থেকে যেতে মানা করেছে।”

উপসংহার

টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রাকৃতিক রত্ন। এর সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ সেখানে ছুটে যান। কিন্তু একের পর এক নিরাপত্তাজনিত সমস্যা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা সেই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা ঝুঁকিগুলো উন্মোচন করে দিচ্ছে।

এই ধরনের দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য কর্তৃপক্ষের যেমন তৎপর হতে হবে, তেমনি নৌকা মালিকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। পর্যটকদের জীবন যেমন অমূল্য, তেমনি টাঙ্গুয়ার হাওরের ভাবমূর্তি রক্ষাও আমাদের সবার দায়িত্ব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button