বিশ্ব

নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেনি ইরান, দেশটির হামলার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী

ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষে সাম্প্রতিক হামলার পর ইরানের সামরিক সক্ষমতা এবং ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। ইরানের সামরিক বাহিনী যদিও নতুন প্রজন্মের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে নামায়নি, তবুও তাদের হামলার কৌশল এবং ব্যবহৃত অস্ত্রপ্রণালী ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছে।

ইরানের পাল্টা হামলার পটভূমি

২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েলের এক প্ররোচিত আগ্রাসী হামলায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত পায়। এতে অনেক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণুবিজ্ঞানী এবং নিরীহ নাগরিক নিহত হন। উত্তরে, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) অ্যারোস্পেস ফোর্স ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’ নামে এক প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

ইরানের হামলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার দশটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

১. রাত-দিন অনিয়মিত সময়ের হামলা: ইরানের সামরিক বাহিনী প্রতিদিন ও রাতে, অবিরাম এবং অপ্রত্যাশিত সময়ে হামলা চালাচ্ছে। এর ফলে ইসরায়েলি বাহিনী সংগঠিত হতে পারছে না এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না।

২. ভুয়া অভিযান ও প্রকৃত হামলার সমন্বয়: ইরান কৌশলে ভুয়া হামলা চালিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করছে, যা সত্যিকারের আক্রমণ সফল করতে সাহায্য করছে।

৩. বিভিন্ন ধরণের মারণাস্ত্র ব্যবহার: ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে আত্মঘাতী ড্রোন পর্যন্ত নানা ধরনের অস্ত্র একসঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা প্রতিরক্ষার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

৪. আধুনিক ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ: ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ‘থাড’, ‘আয়রন ডোম’ এবং ‘ডেভিডস স্লিং’-এর মতো আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পার হয়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করছে। এতে ইসরায়েল বুঝতে পারছে যে, তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা ১০০% কার্যকর নয়।

৫. অপ্রত্যাশিত এবং বৈচিত্র্যময় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: ইরান থেমে থেমে নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, যা প্রতিরক্ষাকে আরও দুর্বল করে তোলে।

৬. ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা: সামরিক ঘাঁটি, বেসামরিক এলাকা, তেল শোধনাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একযোগে আঘাত হানছে, যা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য বড় ধাঁধাঁ সৃষ্টি করেছে।

৭. সীমাহীন আক্রমণ: ইসরায়েলের পুরো ভূখণ্ডে – উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত – ইরান বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে, ফলে ইসরায়েল কোনো স্থানে নিরাপদ নয়।

৮. লক্ষ্যবস্তুর ‘ডেটা ব্যাংক’ থাকা: ইরানের হাতে বিস্তৃত তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, যা থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অবস্থান ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে সঠিক আঘাত করতে সক্ষম হচ্ছে।

৯. সতর্কবার্তা: ইরান বারবার জানিয়েছে যে, অধিকৃত ভূখণ্ডের কোনও স্থানই নিরাপদ নয় এবং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী হামলা হবে।

১০. নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র এখনো ব্যবহার হয়নি: সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরান তার উন্নততর ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এখনও ব্যবহার করেনি, যার অর্থ ভবিষ্যতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরো চমকপ্রদ ও ধ্বংসাত্মক আক্রমণ হতে পারে।

ইরানের সামরিক প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন

ইরানের সামরিক বাহিনী গত দশকে দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তিতে উন্নতি করেছে। ‘হজ কাসিম’ ও ‘খোররমশাহর’ নামক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন ও উন্নয়নের মাধ্যমে তারা নিজস্ব অস্ত্র নির্মাণে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়েছে। এছাড়া আত্মঘাতী ড্রোনের ব্যবহার সামরিক অপারেশনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নতুন ধরনের আক্রমণ মোকাবেলায় জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে বর্তমানে তারা ইরানের বহুমুখী হামলার সামনে বেশ দুর্বল। বিশেষ করে, ‘আয়রন ডোম’ ও ‘থাড’ এর মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করার ঘটনাগুলো ইসরায়েলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে ইরানের সম্ভাব্য নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হলে ইসরায়েলের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাত প্রমাণ করেছে, আধুনিক যুদ্ধ কৌশল এবং প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণের ধরনও ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। ইরানের হামলায় দেখা যাচ্ছে, শুধু অস্ত্রের আধুনিকতা নয়, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা জরুরি। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে এই ধরনের সংঘাত আরও জটিল ও বিধ্বংসী হতে পারে, যা বিশ্বরাজনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button