নাইজেরিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১৫১ জনের, নিখোঁজ হাজারের বেশি

আফ্রিকার বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ নাইজেরিয়ায় আবারও নেমে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের করুণ ছায়া। দেশটির নাইজার প্রদেশে ভয়াবহ বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫১ জন মানুষ। নিখোঁজ রয়েছেন আরও কয়েক হাজার। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, ধ্বংস হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি।
বৃষ্টি আর নদীর স্রোতে তলিয়ে গেছে জনপদ
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা-র বরাতে জানা গেছে, গত বুধবার (২৮ মে) থেকে নাইজার প্রদেশজুড়ে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে উপচে পড়ে আশপাশের নদীগুলোর পানি। এর ফলে হঠাৎ করেই বন্যার পানি ঢুকে পড়ে মোয়াকা শহরসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাইজার প্রদেশের মোকওয়া শহর এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।
নাইজার স্টেট ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির (NSEMA) মুখপাত্র ইব্রাহিম আওদু হুসেইনি জানান, এখন পর্যন্ত ১৫১ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৩ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং উদ্ধার অভিযান চলছে।
“সরকারি হিসাবের চেয়ে বাস্তব অবস্থা ভয়াবহতর”
আল-জাজিরার নাইজেরিয়া প্রতিনিধি আহমেদ ইদরিস বলেন, “এধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকার প্রাথমিকভাবে যে সংখ্যা জানায়, প্রকৃত চিত্র সাধারণত তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে থাকে। নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া মরদেহ এবং নিখোঁজদের অবস্থান এখনও নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়নি।”
তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত ২৬৫টির বেশি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ ঘরহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সেবার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যার কারণ: বাঁধ ভেঙে পড়া, না অব্যবস্থাপনা?
স্থানীয়রা বলছেন, উজানের কোনো বড় বাঁধ হঠাৎ ভেঙে পড়ার কারণেই এই বন্যা হয়েছে। নদীর পানি অতর্কিতে এবং বিপুল স্রোতে এলাকা প্লাবিত হয়। যদিও এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো মন্তব্য এখনো আসেনি। নাইজেরিয়ার আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন চরম আবহাওয়া ও দুর্যোগ আগামীতেও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রেসিডেন্টের শোক ও প্রতিক্রিয়া
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ টিনুবু এক বিবৃতিতে নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও আশ্বস্ত করেন, “ত্রাণ সহায়তা কোনো বিলম্ব ছাড়াই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এবং সরকার দুর্গত এলাকাগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিচ্ছে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নাইজেরিয়ার দুর্বলতা প্রকাশ
এই বন্যা আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে নাইজেরিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোর দুর্বলতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছরই বৃষ্টির মৌসুমে নাইজেরিয়ায় বড় আকারের বন্যা হয়, কিন্তু সময়মতো প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয় ভয়াবহ মাত্রায়।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, নাইজেরিয়ার অবকাঠামো এখনও বন্যা প্রতিরোধে সক্ষম নয়। নদীর পার ও জলাধারগুলো সংস্কার বা বজায় রাখা হয় না বললেই চলে।
বাস্তুচ্যুতদের মানবিক সংকট
আক্রান্ত এলাকাগুলোর মানুষজন বলছেন, তারা তাদের জীবিকা, জমি, গবাদি পশু এবং বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। বহু মানুষ খোলা জায়গায় অবস্থান করছেন, যাদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা এখনো পৌঁছায়নি।
৩২ বছর বয়সী ফাতিমা ইদ্রিস নামের একজন নারী বলেন, “আমার চার সন্তান, স্বামী ও বৃদ্ধা মা– সবাইকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। আমাদের কোনো খাবার নেই, আশ্রয় নেই। বৃষ্টি এখনো থামেনি।”
আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বড় ধরনের সহায়তা আসতে আরও সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়া?
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে (যেখানে নাইজেরিয়া অবস্থিত) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম আবহাওয়ার ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা এবং দীর্ঘস্থায়ী খরা ও অতিবৃষ্টির ধারা জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব।
জাতিসংঘ পরিবেশবিষয়ক সংস্থা UNEP-এর মতে, নাইজেরিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের সম্মুখভাগে অবস্থান করছে, অথচ তাদের প্রস্তুতি অত্যন্ত দুর্বল।
নাইজেরিয়ার নাইজার প্রদেশে চলমান বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি সেই দেশের দুর্বল অবকাঠামো, জরুরি প্রস্তুতির ঘাটতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বহিঃপ্রকাশ। এখন শুধু উদ্ধার নয়, দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন, ত্রাণ সহায়তা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকার নীতিই হতে পারে একমাত্র সমাধান। বিশ্ব সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর এখনই এগিয়ে আসা উচিত, যাতে এই মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর সংকটে না রূপ নেয়।