বিশ্ব

জাতিসংঘে পাকিস্তানি সেনাদের ১৯৭১ সালের যৌন সহিংসতার প্রসঙ্গ তুলল ভারত

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নয়, বরং নারীর প্রতি সংগঠিত নৃশংস সহিংসতারও এক জ্বলন্ত প্রমাণ। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য নারী সেই সময় ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও সেই ক্ষত আজও শুকায়নি। এবার সেই বিষয়টি ফের আলোচনায় এনেছে ভারত।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ‘সংঘাত-সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতা’ বিষয়ক উন্মুক্ত আলোচনায় ভারতের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এলডাস ম্যাথিউ পান্নোস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযোগ তোলেন। তিনি জানান, শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, বরং আজও পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নারী ও কন্যাশিশুরা যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

১৯৭১ সালের ভয়াবহ ইতিহাস

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা নারী নির্যাতনকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, প্রায় ২ লাখ থেকে ৪ লাখ নারী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যৌন সহিংসতার শিকার হন। অনেককে হত্যা করা হয়, অনেকে লজ্জা ও ভয়ের কারণে আত্মহত্যা করেন। সেই সময় এ ধরনের সহিংসতাকে আন্তর্জাতিক মহল ‘History’s Forgotten Holocaust’ হিসেবে বর্ণনা করে।

ভারতের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বলেন—

“১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনারা যে ভয়াবহ যৌন সহিংসতা চালিয়েছিল, তা শুধু নারীদের নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য লজ্জাজনক। দুঃখজনকভাবে, এই ধারা পাকিস্তানে আজও চলছে।”

পাকিস্তানে আজও সংখ্যালঘু নারীদের উপর নির্যাতন

শুধু ইতিহাস নয়, পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিও ভিন্ন নয় বলে অভিযোগ করেন ভারতীয় দূত। তাঁর ভাষায়—

  • পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নারী ও কন্যাশিশুরা অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বাল্যবিয়ে ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
  • অনেককে পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে গৃহস্থালি দাসত্বে বাধ্য করা হচ্ছে।
  • এসব অভিযোগ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই এসব অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

ভারতীয় প্রতিনিধির বক্তব্যে জাতিসংঘে আলোড়ন

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভায় ভারতের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান বর্তমানে পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ভারত স্মরণ করিয়ে দেয়, যে রাষ্ট্র অতীতে এমন ভয়াবহ অপরাধ করেছে এবং এখনো একই ধারা চালাচ্ছে, তাদের মানবাধিকারের বিষয়ে নৈতিক অবস্থান নেওয়ার অধিকার নেই।

বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে—

  • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৯৭১ সালের নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপন করা উচিত।
  • পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি, বরং ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে।
  • ভারতের এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি অপরাধের প্রতি বৈশ্বিক দৃষ্টি ফেরাতে সহায়ক হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন—

“বাংলাদেশের নারীদের উপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন ছিল পরিকল্পিত। এটিকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলা প্রয়োজন।”

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

অবশ্য পাকিস্তান ভারতের এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসকে ব্যবহার করছে। তবে আন্তর্জাতিক মহলের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পাকিস্তান বরাবরের মতো এবারও সত্য অস্বীকার করছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

  • মানবাধিকারকর্মীরা ভারতের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন।
  • যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন মানবাধিকার পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন, যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনকে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি অর্থহীন হয়ে যাবে।
  • জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর থেকেও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

কেন আজও আলোচনায় ১৯৭১ সালের নারী নির্যাতন?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নারী নির্যাতনের ঘটনা কেবল ইতিহাস নয়, বরং একটি চলমান মানবাধিকার ইস্যু। কারণ—

  1. ন্যায়বিচার হয়নি – পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো বিচার হয়নি।
  2. ক্ষমা প্রার্থনা নেই – পাকিস্তান আজও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশি নারীদের কাছে ক্ষমা চায়নি।
  3. বর্তমানের সঙ্গে যোগসূত্র – পাকিস্তানে এখনো সংখ্যালঘু নারীরা একই ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু অতীতের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়কে স্মরণ করায়নি, বরং পাকিস্তানের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতাও সামনে এনেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের নারী নির্যাতন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। আজও এর ক্ষত বহন করছে অসংখ্য পরিবার।

আন্তর্জাতিক মহলের উচিত এ বিষয়ে আরও পদক্ষেপ নেওয়া। যুদ্ধাপরাধ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ বিনা বিচারে ছেড়ে দিলে শুধু ভুক্তভোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, বরং মানবজাতির ন্যায়বিচারের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়বে।

MAH – 12419 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button