জাতীয়

হজ শেষে ঘরে ফেরা শুরু: প্রথম ফ্লাইটে ফিরলেন ৩৭৪ জন হাজি

পবিত্র হজ পালন শেষে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আবার তাদের চেনা জীবনে, আপন ঠিকানায় ফিরতে শুরু করেছেন। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর হজ পালন করে আসা এই মানুষগুলোর মনে এখন আনন্দ আর শান্তি। আজ মঙ্গলবার (১০ জুন, ২০২৫) বেলা সাড়ে ১১টায় প্রথম ফিরতি ফ্লাইটে ৩৭৪ জন হজযাত্রী নিরাপদে দেশে ফিরেছেন। এই বিশেষ ফ্লাইটটি সৌদি আরবের জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। হজযাত্রীদের এই প্রত্যাবর্তন চলবে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত।

ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথম ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। এই ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের চোখেমুখে ছিল হজ পালনের তৃপ্তি আর স্বজনদের কাছে ফেরার আনন্দ।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ জুন তারিখে জামারাতে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। হাজিরা এখন মক্কা থেকে মদিনা এবং পরে জেদ্দা হয়ে নিজ নিজ দেশের পথে যাত্রা করছেন। আজকের দিনে মোট ১২টি ফ্লাইটে ৪ হাজার ৯০৪ জন হাজী বাংলাদেশে ফিরবেন। এই ১২টি ফ্লাইটের মধ্যে ফ্লাইনাসের ৬টি, সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ৫টি এবং বাংলাদেশ বিমানের ১টি ফ্লাইট রয়েছে।

এ বছর বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৮৬ হাজার ৯৫৮ জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য ২২২টি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৯ এপ্রিল হজযাত্রীদের সৌদি আরবে যাওয়ার প্রথম ফ্লাইট শুরু হয়েছিল এবং ৩১ মে পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলেছিল।

হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। এটি এমন একটি ইবাদত, যা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার ফরজ। হজের সময় মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় পবিত্র কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করেন, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন এবং অন্যান্য ধর্মীয় কর্তব্য পালন করেন।

হজ শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলমানরা এখানে এক কাতারে শামিল হন, একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন।

হজের এই দীর্ঘ এবং arduous যাত্রা শেষে, দেশে ফেরা হাজিদের জন্য এক নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ। তারা যেন তাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন, সেই প্রত্যাশা রইল।

হজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

হজ শুধু একটি ভ্রমণ বা তীর্থযাত্রা নয়, এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অনেক গভীর। হজ মুসলিমদের মনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার বীজ বপন করে। এটি মানুষকে ধৈর্য, সহনশীলতা ও ত্যাগের শিক্ষা দেয়। হজের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক।

হজের সময় হাজিরা সাদা কাপড় পরিধান করেন, যা ইহরাম নামে পরিচিত। এই সাদা কাপড় সবার মধ্যে সাম্যের প্রতীক। ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই একই পোশাকে আল্লাহর দরবারে হাজির হন। এটি মুসলিমদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে এক হওয়ার শিক্ষা দেয়।

হজ আমাদেরকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর আদেশে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ)-কে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন। এই ত্যাগের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হজের মাধ্যমে আমরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকার শিক্ষা পাই।

হজের প্রস্তুতি ও নিয়মাবলী

হজে যাওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা, হজের নিয়মকানুন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা অন্যতম। এছাড়া, হজের সময় ব্যবহারের জন্য কিছু জরুরি জিনিসপত্র, যেমন – ইহরামের কাপড়, টুপি, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ব্যক্তিগত ওষুধপত্র ইত্যাদি সাথে রাখা ভালো।

হজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়মাবলী নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • ইহরাম বাঁধা: মিকাত নামক নির্দিষ্ট স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করতে হয়। ইহরাম অবস্থায় কিছু কাজ নিষিদ্ধ, যেমন – চুল কাটা, নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি।
  • তাওয়াফ: কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বা ইশারা করা সুন্নত।
  • সাঈ: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ানোকে সাঈ বলে। এটা বিবি হাজেরা (আঃ)-এর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে করা হয়।
  • আরাফাতের ময়দানে অবস্থান: জিলহজ মাসের নবম তারিখে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। এখানে হাজিরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং দোয়া করেন।
  • মুজদালিফায় রাত্রিযাপন: আরাফাতের ময়দান থেকে ফিরে মুজদালিফায় রাত্রিযাপন করতে হয়। এখানে পাথর সংগ্রহ করে জামারাতে নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
  • জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় তিনটি জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। এটি শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের প্রতীক।
  • কোরবানি: মিনায় কোরবানি করা হজের একটি অংশ। কোরবানি ঈদুল আজহার দিন করা হয়।
  • মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা: হজের শেষ পর্যায়ে মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করে ইহরাম খোলা হয়।

হজের স্বাস্থ্যবিধি

হজের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি। কারণ, এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ একত্রিত হন, তাই রোগ spread করার সম্ভাবনা থাকে। কিছু স্বাস্থ্যবিধি নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • মাস্ক ব্যবহার করা: জনসমাগম স্থানে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।
  • হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা: কিছুক্ষণ পর পর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা উচিত।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করা: ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত।
  • স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া: স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। বাইরের খাবার পরিহার করা ভালো।
  • শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা: সম্ভব হলে অন্যদের থেকে কিছুটা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।
  • নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া: হজের সময় শারীরিক পরিশ্রম হয়, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।

হজের অর্থনৈতিক প্রভাব

হজের অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যান, যা দেশটির অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে। হজ থেকে সৌদি আরবের আয় পর্যটন, পরিবহন, আবাসন এবং অন্যান্য সেবা খাতের মাধ্যমে আসে।

অন্যদিকে, হজ পালনের জন্য বাংলাদেশ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ সৌদি আরবে যায়। এই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর প্রভাব ফেলে। তবে, হজের মাধ্যমে দেশের অনেক মানুষ উপকৃত হন, যেমন – হজ এজেন্সি, পরিবহন সংস্থা এবং অন্যান্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।

হজের ব্যবস্থাপনা

হজের ব্যবস্থাপনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকার ও সৌদি সরকার যৌথভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে। হজ এজেন্সিগুলো হজযাত্রীদের নিবন্ধন, ভিসা, পরিবহন, আবাসন এবং অন্যান্য সেবা প্রদান করে।

বর্তমানে, হজের ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনলাইন নিবন্ধন, ই-ভিসা এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হজযাত্রীদের সেবা আরও সহজ করা হয়েছে।

পবিত্র হজ মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি মুসলিমদের জীবনযাত্রার একটি অংশ। হজের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক। হজ যেন সবার জন্য একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়, সেই কামনা করি।

আশা করি, এই বিস্তারিত প্রতিবেদনটি হজ এবং হজযাত্রীদের বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পারবে। সিগনাল বিডি ডট কম সবসময় সঠিক ও তথ্যপূর্ণ সংবাদ প্রদানে বদ্ধপরিকর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button