বাংলাদেশ

আইনজীবী হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ

চট্টগ্রামে আলোচিত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মূল অভিযুক্ত, সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপত্র চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই দুটি উচ্চপ্রোফাইল মামলায় তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত জোরদার করছে পুলিশ।

আজ রোববার (১৮ মে) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা আদালতের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ার পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন।

চিন্ময় দাস: আলোচিত ব্যক্তি থেকে হত্যামামলার আসামি

চিন্ময় দাস, যিনি ‘সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে আলোচনায় ছিলেন। ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। সেই মামলায় তাকে পরবর্তী মাসের ২৫ নভেম্বর ঢাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তবে আরও বিস্ফোরক ঘটনা ঘটে পরের মাসে, যখন ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় সহিংস সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চিন্ময় দাসের জামিনের শুনানি কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে তা রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় রূপ নেয়।

আদালতের আদেশ ও তদন্ত প্রক্রিয়া

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন জানান, কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। তাকে কারাফটকে (কারাগারের ভেতরেই) জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন।

আদালতের আদেশ অনুযায়ী, পুলিশের একটি বিশেষ টিম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কারাফটকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ পরিচালনা করবে এবং প্রতিবেদন দাখিল করবে।

বিচারের প্রাথমিক অগ্রগতি: স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে যেসব ব্যক্তিদের সরাসরি জড়িত হিসেবে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে চন্দন দাস, রিপন দাস ও রাজীব ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের নির্মম বর্ণনা।

রিপন দাস জানিয়েছেন, তিনি নিহত আইনজীবীর ঘাড়ে বঁটি দিয়ে কোপ দেন। চন্দন দাস কিরিচ দিয়ে কোপান। এরপর সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা ওই আইনজীবীকে অন্তত ১৫-২০ জন মিলে রাস্তায় ফেলে লাঠি, ইট, বাটাম ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

এই বিবরণে উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের সুপরিকল্পিত এবং দলবদ্ধ প্রকৃতি, যা তদন্তে একটি বড় মোড় তৈরি করেছে।

মোট মামলা ও গ্রেপ্তার পরিস্থিতি

সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলার পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলা, বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা, আদালত চত্বরে ককটেল বিস্ফোরণসহ আরও পাঁচটি মামলা হয়। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৬টি মামলা হয়েছে।

এই মামলাগুলোতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫১ জনকে। তাদের মধ্যে ২১ জন সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক রয়েছেন। তদন্তে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, চিন্ময় দাস এই হত্যাকাণ্ডের উসকানিদাতা কি না, তা যাচাইয়ের জন্যই কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা: জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ

২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানার মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন। অভিযোগে বলা হয়, চিন্ময় দাস ও তার সহযোগীরা জাতীয় পতাকা অবমাননা করে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

এই মামলার পরদিনই ফিরোজ খানকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যার পেছনে রাজনৈতিক চাপ ছিল কিনা— সে প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ

একজন আইনজীবীকে আদালত চত্বরে নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনা শুধু একটি ফৌজদারি মামলা নয়; এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনায় বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বারের এক প্রবীণ আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের আদালত চত্বর যদি আর নিরাপদ না থাকে, তবে সাধারণ মানুষ আইনের আশ্রয় কোথায় নেবে?”

চিন্ময় দাসের রাজনৈতিক অবস্থান ও বিতর্কিত কার্যক্রম

চিন্ময় দাস মূলত সনাতনী সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ করার কথা বললেও তার বক্তব্য ও কার্যক্রমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রবিরোধী ভাবধারার উপস্থিতি রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বক্তব্য নিয়েও বহুবার বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে সংগঠিত সহিংসতায় মদদদাতা বা প্ররোচনাকারী হিসেবে ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে তদন্তে তাকে সরাসরি মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা অত্যন্ত জরুরি।

চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়ে আদালত কার্যত তদন্তে নতুন গতি এনেছে।

এখন দেখা যাক, এই জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে কি নতুন তথ্য উঠে আসে এবং তাতে মূল পরিকল্পনাকারী বা উসকানিদাতাদের চিহ্নিত করা যায় কি না। কারণ এই মামলাগুলো শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, বরং রাষ্ট্রের আইন, শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের ওপর সরাসরি আঘাতের প্রতিনিধিত্ব করে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button