যশোরে ভ্যানচালক হত্যাকাণ্ড: ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হত্যা?

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় এক অটোভ্যান চালকের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক শোক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যশোরের শংকরপাশা ফারাজিপাড়া বিলে গত মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সকালে রাস্তার ধারে লিমন শেখ (২৫) নামে এক যুবকের অজানায় মৃত্যু রহস্যের খোঁজে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।
নিহত লিমন শেখ কে?
নিহত লিমন শেখ ছিলেন নওয়াপাড়া পৌর এলাকার বুইকরা ওয়ার্ডের কাসেম শেখের ছেলে। চার ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। কয়েক বছর ধরে যশোর শহরের বিভিন্ন স্থানে অটোভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। ভ্যান চালানো ছাড়াও, জিলা বাজারের একটি বস্তার দোকানে নিয়মিত বস্তা বহনের কাজ করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা কাজে শেষে বাড়ি ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন লিমন।
কিন্তু গত সোমবার রাতে লিমন বাড়ি ফিরেনি। এ নিয়ে তার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সকালে স্থানীয়রা তার মরদেহ রাস্তার ধারে একটি বিলে পড়ে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়।
পুলিশি তদন্ত ও মরদেহের অবস্থা
অভয়নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আলীম সংবাদকর্মীদের জানান, মৃতদেহটি কোন বাহ্যিক আঘাতবিহীন থাকলেও শরীরে শ্বাসরোধের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই কারণে ধারণা করা হচ্ছে, লিমনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া তার ব্যবহৃত অটোভ্যানটি এখনো পুলিশকে উদ্ধার করতে পারেনি।
এই প্রেক্ষিতে পুলিশ মনে করছে, ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, আজকাল যশোরসহ সারাদেশে এমন ধরনের ছিনতাই ও গ্যাংরেলেটেড হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনসাধারণের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিক তথ্য ও সুরক্ষা ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি মৃতকের পরিবারের কাছ থেকেও তদন্ত করছে। দ্রুততম সময়ে মূল অপরাধীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে কঠোর অভিযান অব্যাহত থাকবে।
যশোরে বেড়ে চলেছে ছিনতাই ও সন্ত্রাসের ঘটনা
যশোর জেলা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিনতাই, সন্ত্রাস ও গ্যাংকোয়ারের কারণে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় অটোভ্যান চালক, পণ্য বহনকারী শ্রমিকদের উপর ছিনতাই ও হামলার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে।
স্থানীয়রা বলছেন, “আমরা এখন ভয় পাচ্ছি। কাজ করতে বের হলেই মনে হয় কোন বিপদে পড়ব কি না। পুলিশের কাছে নিরাপত্তার দাবি করেছি, কিন্তু সুরাহা হয়নি।”
অভয়নগর থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল আলীম বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ ধরণের ঘটনায় কোন পক্ষ যেন অবিচারের শিকার না হয়, সেজন্য কঠোর তদন্ত চলছে।”
ছিনতাই ও হত্যাকাণ্ডের পেছনের কারণ কী?
বাংলাদেশের প্রায় সব বড় শহর ও জেলা শহরে ছিনতাই ও সন্ত্রাসের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। যশোরেও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে অটোভ্যান চালক, মোটরসাইকেল চালক ও ছোট ব্যবসায়ীদের উপর এ ধরনের হামলা বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অপরাধের পেছনে মূলত:
- অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দারিদ্র্য
- যুব সমাজের কর্মসংস্থানের অভাব
- অপরাধমূলক গ্যাং ও সন্ত্রাসী চক্রের সক্রিয়তা
- পুলিশি নজরদারির ঘাটতি
এসব কারণে কিছু যুবক অপরাধের পথ বেছে নিচ্ছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও জনগণের প্রত্যাশা
সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যশোরসহ সারাদেশে পুলিশি টহল জোরদার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ক্যামেরা স্থাপন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, দুর্বৃত্তদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, “তালাব দিয়ে বাড়ি বন্ধ করলেই হয় না, আমাদের রাস্তাতেই নিরাপত্তা চাই।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলেছেন, “আমরা চাই দুর্বৃত্তরা যাতে আইনের আওতায় আসে এবং কেউ যেন নিরাপদ মানুষকে ক্ষতি করতে না পারে।”
কি করতে হবে?
১. জনগণকে সচেতন হতে হবে: রাতের বেলা বিশেষ করে একা চলাচল এড়াতে হবে।
২. সঠিক তথ্য পুলিশের কাছে জানানো: অপরাধীর তথ্য জানালে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
৩. স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা: সিসিটিভি ক্যামেরা ও পর্যাপ্ত পুলিশ টহল জরুরি।
৪. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি: যুব সমাজের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে অপরাধ প্রবণতা কমানো যেতে পারে।
যশোরের অভয়নগরে লিমন শেখের হত্যাকাণ্ড শুধু এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি একটি প্রতিকূল সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটের পরিচয়। পুলিশি তদন্ত ও দ্রুত আইনি ব্যবস্থা প্রত্যাশিত হলেও, এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নয়, জনগণ, প্রশাসন ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
নিহতের পরিবার, স্থানীয় জনগণ এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষ নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন যাপন করার অধিকার রাখে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
MAH – 12270 , Signalbd.com