অর্থনীতি

পরবর্তী সরকারকেও ব্যাংকিং খাত সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সরকারের মেয়াদেই পাচারকারীদের কয়েকজনের বিদেশের সম্পদ জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে পরবর্তী সরকার যদি এই সংস্কার কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে না নেয়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক কারণে যেন এই প্রক্রিয়া থেমে না যায়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলা পাচারের টাকা ফেরত পেয়েছে। কোনো দেশই পাচার করা টাকা পাঁচ বছরের আগে ফেরত নিতে পারেনি। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে পাচারকারীদের বিদেশের সম্পদ জব্দ করা যায় এবং এটি যেন ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে।’

ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি

সেমিনারে ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়েও আলোচনা হয়। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ব্যাংকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এই খাতকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আমানত, ঋণ, আমদানি, রপ্তানিসহ সব ধরনের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারি, তাহলে অনিয়মের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যাবে। এতে করে ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে অর্থায়ন করতে পারবে এবং অতিরিক্ত ঋণ প্রদান রোধ করা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাইরের দেশে পালিয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশে থেকে ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করেন, তাহলে আমাদের সেই লেনদেন শনাক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যভান্ডার নেই। তাই একটি আধুনিক তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে, যা ভবিষ্যতে অর্থ পাচার রোধে সহায়তা করবে।’

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও কর ব্যবস্থার উন্নয়ন

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। তবে এখন এসব চ্যালেঞ্জ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায় অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসার মধ্যে খাদ্যকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও সুদহার বৃদ্ধি করা হয়েছে, তবে মূল্যস্ফীতির হার এখনো অনেক বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলার জন্য প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি করতে হবে। পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হলে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ বাড়বে। জনগণ এখন ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে চায়। দীর্ঘদিনের অনিয়মের সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। নমুনা হিসেবে হলেও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে পরবর্তী সরকার এসে বলতে না পারে যে ব্যাংক খাত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়।’

অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতিতে এত সমস্যা আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে বর্তমানে অর্থ পাচার কমে আসছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবাসী আয়ও বাড়ছে, বিশেষ করে দুবাই থেকে আসা আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, দুবাইয়ে খুব বেশি বাংলাদেশি না থাকলেও সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আসছে। এর কারণ হলো, কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য দেশ থেকে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করছে। আমরা এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছি না।’

গভর্নর আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫-১১ মাস সময় লাগবে। আরও ৬ মাস কঠোর নীতি প্রয়োগ করলে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে। নীতিগত দিক থেকে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকে ও খোলাবাজারে ডলারের মূল্য প্রায় সমান হয়ে এসেছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ।’

ব্যাংক খাতে সংস্কার ও আইনি পরিবর্তন

ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সরকার নতুন ‘ব্যাংক রেজল্যুশন আইন’ প্রণয়ন করছে বলে জানান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘একটি ব্যাংক থেকে একটি পরিবার ৮৭ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে। এই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা বলা কঠিন। তবে আমাদের নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। তবে আমাদের সক্ষম জনবল কম থাকায় কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আইন পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক খাতের সঠিক প্রতিপালন, তদারকি ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং কোনো রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়বে না।’

সংস্কার অব্যাহত রাখার আহ্বান

সেমিনারে বক্তারা বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটিকে ভবিষ্যতে আরও জোরদার করতে হবে। পরবর্তী সরকারকেও এই সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে, যাতে অর্থ পাচার রোধ, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা এই পরিবর্তনের সূচনা করছি, তবে এটি সফল করতে হলে ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। পরবর্তী সরকারকেও এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে আমরা একটি শক্তিশালী ও স্বচ্ছ অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারি।’

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button